বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অন্যতম উৎস প্রবাসী আয়ে সুদিন ফিরছে। চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম ৯ মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৬০৩ কোটি ডলার। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ১ হাজার ৫২৯ কোটি ডলার। বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকগুলোকে বাজারভিত্তিক দামে রেমিট্যান্সের ডলার কেনার সুযোগ দিলে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় আরও বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, মার্চ মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ আগের মাস ফেব্রুয়ারির চেয়ে ২৯ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৫৬ কোটি ডলার। মার্চে ২০১ কোটি ৭৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার রেমিট্যান্স এসেছে ব্যাংকের মাধ্যমে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যাংকগুলো ডলারের দাম বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) নির্ধারিত রেটের চেয়ে বেশি দেওয়ায় ছয় মাস পর মার্চে ২০০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আয় এসেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংকগুলোকে প্রবাসী আয়ের ডলার কেনার রেট নির্ধারণ করে দেওয়ায় ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে রেমিট্যান্স। এলসি নিষ্পত্তিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে চাহিদামতো ডলার না পাওয়ায় ১১৮ থেকে ১২০ টাকায় প্রবাসী আয়ের ডলার কেনা শুরু করে অন্তত ১২টি ব্যাংক। আর এ কারণেই ছয় মাস পর বৈধপথে বেড়েছে রেমিট্যান্স।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ২১০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠান প্রবাসীরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। সেপ্টেম্বরে হোঁচট খায় প্রবাসী আয়। এক ধাক্কায় নেমে আসে ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলারে। অক্টোবরে তা আরও কমে ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ ডলারে নেমে আসে।
পরের মাস নভেম্বর থেকে প্রবাসী আয় ফের বাড়তে শুরু করলেও সেপ্টেম্বরের আগের অবস্থানে ফেরেনি। নভেম্বরে এসেছে ১৫৯ কোটি ৫২ লাখ ডলার। ডিসেম্বরে ১৭০ কোটি ডলার। চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আসে ১৯৬ কোটি ডলার। ফেব্রুয়ারিতে কমে ১৫৬ কোটি ১২ লাখ ডলারে নেমে আসে। ছয় মাস পর মার্চে আবার ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে প্রবাসী আয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রবাসী আয়ের ডলারের দাম ১০৭ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়ার আগে প্রতি মাসে ৫ থেকে ৬ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স আয় করতাম। দাম নির্ধারণের পর থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমাদের মাসে রেমিট্যান্স আয় হয়েছে গড়ে ২ থেকে আড়াই কোটি ডলার। প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার কারণে ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তিতে অনেক ব্যাংক বেশি দামে ডলার কেনা শুরু করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাফেদা ডলারের দর ১০৭ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১১৭ টাকা দর দেওয়ার ফলেই ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ বেড়েছে। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ডলারের দাম ১০৮ টাকা থেকে কমিয়ে ১০৭ টাকা করার পর গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকেই মাসিক রেমিট্যান্স প্রবাহ ২০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচেষ্টায় ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা কমাতে আমরা কাজ করছি। এই চাহিদা সাধারণত তৈরি হয় আন্ডার-ইনভয়েসিং থেকে। আমরা যদি আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার-ইনভয়েসিং কমাতে পারি, তাহলে হুন্ডিও বন্ধ করতে পারব।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বাড়ানোর জন্য ডলারের বাজারভিত্তিক দামের বিকল্প নেই। আন্তব্যাংক এবং কার্ব মার্কেটে ডলারের দামের ব্যবধান কমিয়ে আনার জন্য ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। ব্যাংক এবং কার্ব মার্কেটে ডলারের দামের ব্যবধান বেশি হওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বাড়ছে না।