বিশ্বের ১১টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাপানের প্রভাবশালী পত্রিকা নিক্কেইকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেছেন।
আগামী মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) জাপানে সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। এর আগে গত ১৮ এপ্রিল ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে তিনি নিক্কেইয়ের সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছেন।
জাপান সফরে তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত সম্পর্ক উন্নয়ন ও অংশীদারত্ব বাড়াতে বৈঠক করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে মোকাবিলা করতে জাপান ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।
সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতিসংঘ ঘোষিত দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর রপ্তানি শুল্ক থেকে অব্যাহতি পায়। এ জন্য স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ একটি ‘ভিন্ন পরিস্থিতির’ মুখোমুখি হবে।
বাংলাদেশ ২০২৬ সাল নাগাদ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে ‘উন্নয়নশীল’ দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ কারণে বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তি করতে চাই। বর্তমানে ১১টি দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আমাদের আলোচনা চলছে।’
ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমিত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। কিন্তু কোনো দেশের সঙ্গে ‘এফটিএ’ বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নেই। তবে কোন কোন দেশের সঙ্গে এফটিএ নিয়ে আলোচনা চলছে, তা জানাননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে ধারণা করা হচ্ছে, দেশগুলোর মধ্যে ভারত, চীন ও জাপান রয়েছে।
চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। পোশাক খাতের বাইরে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও ডিজিটাল যন্ত্রপাতিকে প্রতিশ্রুতিশীল খাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া তিনি মৎস্য সম্পদসহ বঙ্গোপসাগরের সম্পদের কথাও তুলে ধরেছেন তাঁর সাক্ষাৎকারে।
নিক্কেইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীন বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। তবে শেখ হাসিনা নিরপেক্ষ কূটনীতির প্রতি তাঁর অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘কীভাবে দেশকে উন্নত করা যায়, সেটিই আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার। আমাদের উন্নয়নের জন্য প্রতিটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে আমরা বদ্ধ পরিকর।’
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে তাঁর মেয়াদকালে ৪৪০ কোটি ডলার বা ৬০০ বিলিয়ন ইয়েন (জাপানি মুদ্রা) সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরবর্তী সাত বছরে জাপানি সহায়তা ঋণ আরও বেড়ে ১ দশমিক ৬৫ ট্রিলিয়ন ইয়েনে পৌঁছেছে।
জাপানের সহায়তায় দেশে প্রথম মেট্রো রেল, প্রথম শিল্প পার্ক, শাহ জালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি নতুন টার্মিনাল ও মাতার বাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে জাপান অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা রাখছে।’
নিক্কেইয়ের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ এবং ঋণ বেড়েছে। এ ব্যাপারে শেখ হাসিনা সতর্ক রয়েছেন। এ জন্য মাতার বাড়ি সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে চীনা সহায়তা না নিয়ে জাপানি সহায়তা নিয়েছেন তিনি।
এদিকে জাপান তার নতুন অফিশিয়াল সিকিউরিটি অ্যাসিসটেন্স (ওএসএ) প্রোগ্রামের প্রথম বছরে বাংলাদেশকে চারটি সম্ভাব্য দেশের একটি হিসেবে পরিকল্পনায় রেখেছে। এর ফলে বাংলাদেশ জাপানের কাছ থেকে বিনা মূল্যে সামরিক সরঞ্জাম পেতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ যে অর্থনৈতিক সমস্যায় নেই, তা নয়। রিজার্ভ সংকট মোকাবিলা করতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা নিয়েছে।
নিক্কেই বলেছে, গণতন্ত্র নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে বাংলাদেশে। এ কারণে গত মাসে অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি যুক্তরাষ্ট্র। যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘গণতন্ত্র রক্ষা করতেই আমি এসেছি।’
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় একাধিকবার সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের নজির রয়েছে। সেনবাহিনীর সঙ্গে বর্তমান সরকারের আস্থা তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার সময়ে তাদের (সেনাবাহিনীর) যে অগ্রগতি হয়েছে, তা তারা স্বীকার করে।’
প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীও বাংলাদেশকে চাপে ফেলেছে বলে উল্লেখ করেছে নিক্কেই। শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটি এমন একটি বোঝা, যা আমাদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। আমরা বাইরের বিশ্ব থেকে যেসব সমর্থন পেতাম, তা আসলে কমে যাচ্ছে।’ তিনি মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ এবং তাড়াতাড়ি প্রত্যাবর্তনের জন্য একটি পরিবেশ তৈরিতে সহযোগিতার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।