শতকোটি টাকার বেশি খরচ এবং শতাধিক মামলা করেও গুজব ঠেকানো যাচ্ছে না। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, তদারকি, নিবন্ধন ও জবাবদিহির আওতায় আনতে চায় সরকার। এ জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলেছে, গত চার বছরে বিভিন্ন সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, ধর্মীয়, সরকারপ্রধান, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আমলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বাহিনীর সদস্য, মৃত্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব গুজবের কোনোটি দেশের ভেতর থেকে, আবার কোনোটি দেশের বাইরে থেকে ছড়ানো হয়। মূলত দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে এমন গুজব।
এমন গুজব ঠেকাতে পুলিশের কয়েকটি বিশেষায়িত ইউনিটে সাইবার ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। একেকটি ল্যাব স্থাপনে খরচ হয়েছে ৮ কোটি থেকে ২০০ কোটি টাকা পর্যন্ত। কেনা হয়েছে ডিজিটাল সরঞ্জাম। আরও সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে। এ ছাড়া গুজব ছড়ানোর ঘটনায় গত প্রায় তিন বছরে শুধু রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন থানায় অন্তত ৯৮টি মামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে রমনা মডেল থানায়।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মনজুর রহমান বলেন, ‘গুজবের বিরুদ্ধে আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছেন। গুজবকারীকে শনাক্ত, গুজবের কনটেন্ট সরানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে ২৪ ঘণ্টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটরিং করা হয়। পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটগুলোর ফরেনসিক ল্যাবগুলোও আধুনিকায়ন করা হয়েছে।
সূত্রগুলো বলছে, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) গত চার বছরে অর্থ পেয়ে সাইবার ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন করেছে। ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উত্তর ও দক্ষিণের জন্যও ল্যাব স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। এ জন্য চলতি অর্থবছরে টাকা বরাদ্দের কথা রয়েছে। সিআইডি রাজশাহী, খুলনা, রংপুরের পর সব বিভাগেই ফরেনসিক ল্যাব তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলেছে, র্যাবের ফরেনসিক ল্যাবের জন্য ২০১৮ সালের শেষ দিকে ১২৫ কোটি ৩৯ লাখ টাকা দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের মধ্যে র্যাব তাদের ল্যাব আধুনিকায়ন করে। ২০১৮ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় সিটিটিসির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব পেয়েছে। ল্যাবে অপরাধী শনাক্ত করতে আধুনিক সব সরঞ্জাম স্থাপন করা হয়েছে। জঙ্গি প্রতিরোধের পাশাপাশি গুজব প্রতিরোধেও কাজ করছে সিটিটিসি। র্যাব ও সিআইডির ল্যাব সবচেয়ে আধুনিক।
ল্যাব স্থাপনে মোটা অঙ্কের অর্থ খরচের পাশাপাশি প্রতিবছর এই খাতে ব্যয় বাড়ছে। পুলিশের কয়েকটি ইউনিটের সাইবার ফরেনসিক ল্যাবে সাত থেকে আটজন প্রযুক্তিবিদ ও তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) বিশেষজ্ঞ মাসিক সম্মানীতে কাজ করছেন।
সূত্র বলেছে, ইন্টারনেটে তথ্য যাচাই করা দেশের কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে গুজবসংক্রান্ত বিষয়ে সহায়তা নিচ্ছে পুলিশ। এই আউটসোর্সিংয়ের জন্যও বছরে কোটি টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে। দেশের ১১টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া যেকোনো বিষয়ের সত্য-মিথ্যা যাচাই করে। যে মাধ্যম থেকে ছড়ানো হয়েছে, সেখানে এসব প্রতিষ্ঠান বিষয়টি জানিয়ে দেয়।
আউটসোর্সিংয়ে কাজ করা এক তরুণ জানান, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কাজ করা প্রযুক্তিবিদদের মাসিক বেতন দেওয়া হয়।
ঢাকায় গুজবের ৯৮ মামলা
গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ২০২০ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত রাজধানীতে অন্তত ৯৮টি মামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫টি, ২০২১ সালে ৪২টি, ২০২২ সালে ৩৬টি এবং চলতি বছরের মে পর্যন্ত ৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য বা গুজব ছড়ানোর অভিযোগ করা হয়েছে। মামলাগুলোর তদন্ত করছে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। তবে তদন্তে অগ্রগতি কম।
৩০ শতাংশ লিঙ্ক সরানো হচ্ছে
সূত্র বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা গুজব ও মিথ্যা তথ্যের লিঙ্কগুলো সরিয়ে ফেলতে তালিকা দেয় বিটিআরসিকে। এরপর সেগুলো সরাতে বিটিআরসি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে অনুরোধ করে। তবে এসব ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ লিঙ্ক সরানো হয়। বাকিগুলোকে মতামতের স্বাধীনতা হিসেবে উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো এড়িয়ে যায়।
বিটিআরসির সূত্র বলেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরাধ দমনে সোশ্যাল মিডিয়া রেগুলেটরি অথরিটি গঠনের কাজ চলছে।বিটিআরসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্বব্যাপী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সঙ্গে যারা সরাসরি কাজ করবে, তাদের দেশে অনুমোদন দেওয়ার ও মনিটরিং করার সোশ্যাল মিডিয়া রেগুলেটরি অথরিটি গঠনের কাজ চলছে। আগামী বছরের দিকে এটি গঠন করা হতে পারে।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানভীর হাসান জোহা গুজব প্রতিরোধে তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, সমাজে অবাধ তথ্যপ্রবাহ থাকলে সে বিষয় নিয়ে গুজব হবে না। এ ছাড়া গুজব রটনাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করলে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সঙ্গে চুক্তি করলে গুজব কমবে।