বিয়ের আসরে ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ পায়ের কাছে গড়িয়ে এসে থেমে গেল একটা স্বর্ণের আপেল। তাতে আবার খোদাই করে লেখা ‘সেরা সুন্দরীর প্রাপ্য’। আর যায় কোথায়, বেঁধে গেল বিশাল হট্টগোল। আসরে থাকা সব নারী ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজেকে সুন্দরী প্রমাণ করার জন্য। সেই সব নারী কিন্তু কোনো সাধারণ নারী নন, প্রত্যেকেই তাঁরা দেবী। তাঁদের মধ্যে তিনজনের একজন হলেন— দেবরানি হেরা, যিনি আবার অর্থসম্পদেরও দেবী। অন্যদের মধ্যে যথাক্রমে আছেন যুদ্ধের দেবী অ্যাথেনা, যিনি একাধারে জ্ঞান-বিজ্ঞান, কারুশিল্প ও এথেন্স নগরীর রক্ষাকর্ত্রী; প্রেম ও রূপের দেবী আফ্রোদিতি, যিনি লাস্যময়ী ও সৌন্দর্যের অধিষ্ঠাত্রী।
সেদিন খুব বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং দেবতা জিউস। শেষ পর্যন্ত বিচারের ভার তিনি নেননি অবশ্য। তিন দেবী তাই চলে গিয়েছিলেন বিশ্বের সেরা সুদর্শন পুরুষ প্যারিসের কাছে। প্যারিসকে বিচারের ভার দিয়ে তাঁরা আবার গোপনে তাঁকে নানা রকম উৎকোচের লোভও দেখালেন। হেরা বললেন, তাঁকে সেরা ধনীতে পরিণত করবেন। অ্যাথেনা লোভ দেখালেন, সেরা বীরের খ্যাতি লাভের। আর আফ্রোদিতি তাঁর সামনে তুলে ধরলেন বিশ্বের সেরা চোখ ধাঁধানো রূপের অধিকারী মানবী হেলেনের প্রেমের আকর্ষণ। প্রেমকে প্রাধান্য দিয়ে প্যারিস তাই সেরা সুন্দরী হিসেবে ঘোষণা করলেন আফ্রোদিতিকে।
সম্ভবত এটিই ছিল পৃথিবীর প্রথম নারীর সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা, যার হাত ধরে পুরুষতন্ত্র ঠিক করে দিয়েছিল কী কী বাহ্যিক গুণ থাকলে একজন নারী সুন্দরী বলে বিবেচিত হবে।
এই গ্রিক মিথ অনুযায়ী বলতে গেলে নারীকে হতে হবে ফরসা, চিকন, টানা চোখ, লম্বা চুল, মেদহীন কোমর এবং কপোলের অধিকারী! গত কয়েক দশকে নানান ক্ষেত্রে নারী উন্নতি সাধন করলেও এক অদৃশ্য মানদণ্ডে প্রতিনিয়ত নিজেদের পুরুষতান্ত্রিক ছুঁড়ি কাঁচির নিচে ঠেলে দিচ্ছে অসংখ্য নারী। মিডিয়া থেকে শুরু করে চিকিৎসা বিজ্ঞান পর্যন্ত প্রচার করে যাচ্ছে নারীর সৌন্দর্যের এক ভয়াবহ মানদণ্ড।
সাম্প্রতিক ঘটনাই যদি বলি, বিশ্বজুড়ে জয়জয়কার এখন এআই–এর উন্নত প্রযুক্তির। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভাবনীয় উদ্ভাবনের ছোঁয়া এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের একটি স্বনামধন্য টিভি চ্যানেলে সংবাদ পাঠ করেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ‘অপরাজিতা’। তাকেও দেওয়া হয়েছে নারীর শারীরিক গঠন। খালি চোখেই দেখা যায় অপরাজিতার গায়ের রং ফরসা, তার নাক টিকোলো, টানা চোখ, ঠোঁটের গঠন পাতলা। অর্থাৎ প্রসঙ্গ যখন নারীকে উপস্থাপন করা তখন নারীর বাহ্যিক কাঠামোই মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। কারণ পুঁজিবাদের কাছে নারীর সৌন্দর্যও একটি পুঁজি এবং সম্পদ, যার অর্থমূল্য রয়েছে এবং যার ওপর ভিত্তি করে একটি আলাদা বাজার তৈরি করা সম্ভব।
তবে পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নারীর সৌন্দর্যের মিথ বিস্তৃত হয়ে উঠলেও নারীর সৌন্দর্যের সমাজসৃষ্ট ধারণা যে একেবারে নতুন নয় তা তো গ্রিক পুরাণের কাহিনি থেকেই কিছুটা স্পষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়া সামন্ততন্ত্রও নারীকে বিভক্ত করেছিল দুই ভাগে—গৃহবধূ ও নগরবধূ। প্রাচীন ভারতের নিয়ম ছিল, রাজকন্যা না হলে অত্যন্ত রূপবতী কোনো নারীকে কেউ একা কুক্ষিগত করে রাখতে পারবে না। সেই নারীকে নাচে, গানে পারদর্শী করে তুলে নটী বানিয়ে তুলতে হবে সব পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য।
এই সব ইতিহাসের নিদারুণ উদাহরণ হচ্ছে প্রাচীন ভারতের বৈশালী নগরের সুন্দরী কিশোরী আম্রপালি, যাকে অপরূপ রূপ লাবণ্যের অধিকারী ঘোষণা করে বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল নগরবধূ!
এ তো গেল প্রাচীন ভারতের কথা। বর্তমান বিশ্বের নারী উন্নয়নের অন্যতম ধারক বাহক ইউরোপও কিন্তু নারীর সৌন্দর্যকে বরাবরই দেখেছে পুরুষতন্ত্রের চোখে। উনিশ শতকেও ইউরোপে নারীর সৌন্দর্যের অন্যতম মানদণ্ড ছিল সরু কোমর। বলা হতো, পুরুষ যেন দুহাতের মুঠোয় একজন নারীর কোমর ধরতে পারে। সরু কোমর লাভের আশায় শিশুকাল থেকে নারীকে লোহার জালির তৈরি করসেট পরিয়ে রাখা হতো। ভাঙা চোয়াল ও টোল পড়া গাল সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো বলে সে সময় মাড়ির দুটি দাঁত ফেলে দিতেন ইউরোপের নারীরা!
নারীর সৌন্দর্য সংক্রান্ত মিথ বহু পুরোনো হলেও পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। কারণ নারীর রূপ ব্যবহার করে প্রসাধন পণ্যের বাজার তৈরি করা সম্ভব ছিল। সুন্দরী নারীকে অবশ্যই ফরসা হতে হবে—প্রচলিত এই ধারণা প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে রং ফরসাকারী ক্রিম বিক্রির হার বাড়ানোয়। নারীকে ‘সুন্দর করে তুলবে’ এই আশ্বাসে প্রতিনিয়ত বাজারে আসছে বিভিন্ন রকম প্রসাধনী, যার ক্রেতা নারীরাই। তবে পুরুষের চোখে সুন্দর হওয়ার বাসনা থেকেই যে অবচেতন মনে নারী এসব প্রসাধন ব্যবহার করছে এমনটাই মনে করেন অনেকে।
১৯৭০ সালে ফেমিনিস্ট গ্রুপ প্রথম প্রতিবাদ জানায় নারীর সৌন্দর্যের মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেওয়ার বিষয়ে। তারা বলেছিল যে, ‘শরীর’ ধারণাটি যতটা না বায়োলজিক্যাল, তার চাইতেও বেশি সামাজিক–অর্থনৈতিক। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত ফরাসি লেখক ও দার্শনিক সিমোন দ্য বোভেয়ার বলেছেন, ‘কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, ধীরে ধীরে সে নারী হয়ে ওঠে!’
বিখ্যাত লেখক নাওমি উলফ তাঁর ‘দ্য বিউটি মিথ: হাউ ইমেজেস অব বিউটি আর ইউজড এগেইনসড ওমেন’ বইতে বলেছেন, ‘দিনে দিনে ইটিং ডিসঅর্ডার বাড়ছে। কসমেটিক সার্জারি দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে মার্কেটে, পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রি শাসন করছে মিডিয়াকে। প্রায় ৩৩ হাজার নারী সায় দিচ্ছে, যেকোনো লক্ষ্য অর্জন করার চাইতে তারা নিজেদের শারীরিক ওজন ১০ থেকে ১২ পাউন্ড কমাতে বেশি স্বচ্ছন্দ। অনেক নারী এখন প্রচুর উপার্জন করছে, শক্তিমত্তায় কিংবা মর্যাদায় এগিয়ে আছে। কিন্তু যখনই তাদের বলা হয়, তারা তাদের শরীর নিয়ে কী ভাবছে? তখনই বোঝা যায়, তাদের অবস্থা তাদের অশিক্ষিত বন্দী জীবন কাটানো দাদি নানিদের চাইতেও খারাপ।’
নওমি উলফের মতে, নারী যে প্রতিনিয়ত সুন্দর হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় নিজেকে নামাচ্ছে সেটা মূলত করছে অবচেতন মনে। কারণ জন্ম থেকে তার মস্তিষ্কে গেঁথে দেওয়া হয়েছে নারী সৌন্দর্যের এক মিথোলজিক্যাল মানদণ্ড। দীর্ঘদিন মানসিক এবং রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত হতে হতে তারা ভাবতে শিখেছে শারীরিকভাবে সুন্দর হওয়াটাই কেবল নারীদের শক্তি! যার ফলে নারীর প্রতি শারীরিক অত্যাচার নিচ্ছে নতুন মাত্রা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারী নিজেই দাঁড়াচ্ছে নিজের বিরুদ্ধে। যার অন্যতম উদাহরণ প্লাস্টিক সার্জারির মতো বিষয় আশয়। এ সবকিছুই যেন নারীকে ‘মানুষ’ নয় ‘সুন্দর পুতুল’–এ রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা মাত্র।
মূলত সুন্দরী নারীর ধারণা পুঁজিবাদ এবং পুরুষতন্ত্রের উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্যই গড়ে উঠেছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় চোখ ধাঁধানো জমকালো পরিবেশে পালিত হওয়া বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতার দিকে নজর দিলেই। বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার অন্যতম একটি শর্ত হলো, প্রতিযোগীকে অবশ্যই অবিবাহিত হতে হবে। কেননা, একজন বিবাহিত নারী এরই মধ্যে একজন পুরুষের দখলে থাকে। তাই বাজারে চাহিদা তৈরি করার জন্য এই মনস্তাত্ত্বিক রাজনীতির সহায় নেয় পুঁজিবাদ। কারণ অবিবাহিত নারী হতে পারে অন্য সব অবিবাহিত নারীর আইকন, যারা প্রত্যেকেই স্বপ্ন দেখে ব্র্যান্ড আইটেম ব্যবহার করে ওই রকম মনোলোভা হয়ে উঠতে পারার।
শারীরিক সৌন্দর্য বরাবরই একটি আপেক্ষিক বিষয়। রূপের মাপকাঠি একেক জায়গায় একেক রকম। পিগমি জাতির কাছে খর্বকায় নারীই সুন্দর, আফ্রিকায় সুন্দর কালো রঙের নারী। নারীর সৌন্দর্যের বর্তমান যে ধারণা প্রচলিত তা মূলত ইউরোপীয় পুঁজিবাদের অংশ। এতটাই সূক্ষ্মতার সঙ্গে নারীর সৌন্দর্যের একটি গঠন মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে প্রযুক্তিকে পর্যন্ত ফরসা, লম্বা, চিকন নাক আর ঠোঁটের বাহ্যিক রূপ দেওয়া হয়েছে। তা না হলে তথাকথিত সৌন্দর্যের অভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে কনজ্যুমার।
আমাদের দেশে এখনো কোনো মেয়ে যদি কর্মক্ষেত্রে উন্নতি করে, তার মেধা বা বুদ্ধির প্রশংসা করা হয় না। বলা হয়, ‘দেখতে ভালো হওয়ার’ কারণে সে পদোন্নতি পেয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কখনো মানতেই পারে না নারীর বুদ্ধি বা মেধা থাকতে পারে। তাদের আরোপিত ধারণা হচ্ছে, সৌন্দর্যই একজন নারীর সব।
পুরুষতন্ত্র এবং পুঁজিবাদের আরোপিত সুন্দরী নারীর ধারণা প্রকৃত অর্থে নারীর জন্য কোনো সুফল বয়ে আনে না। বরং সৌন্দর্যের মানদণ্ডে সমাজের নারীদের একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার উৎসাহ দেয়। এতে করে নারী নিজেই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। সর্বোপরি মানুষের রূপের প্রকৃত মাপকাঠি আর সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, প্রতিযোগিতা কখনোই নয়। সৌন্দর্যের মানদণ্ড ঠিক করে দেওয়ার মতো কোনো কর্তৃপক্ষ কখনোই থাকা উচিত নয়। আর এই মিথ ভাঙতে এগিয়ে আসতে হবে নারীদেরই। নিজের মেধা ও মনন গঠনে নারী যত বেশি মনোযোগ দেবে ততই সমাজ নারীর সৌন্দর্য নিয়ে মাথা ব্যথা কমাবে।