২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০৮:৪৩:০১ অপরাহ্ন
ব্যবসায়ীদের লাভের চাপে চ্যাপ্টা মানুষ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৮-২০২৩
ব্যবসায়ীদের লাভের চাপে চ্যাপ্টা মানুষ

উৎপাদন কমেনি, চাহিদাও বাড়েনি। অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের চোখে ধুলো দিয়ে নিত্যপণ্য ব্যবসার আড়ালে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিচ্ছেন ব্যবসায়ী-আমদানিকারকেরা। আধিপত্য আর প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে গত দুই অর্থবছরে কৃষিজাত পণ্য ও সেবা, ভোজ্যতেল, চিনি আর মৎস্য-পোলট্রি খাত রাজস্ব-সুবিধা নিয়েছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা। বাজারে এসব পণ্যের দাম তো কমেইনি, বরং নানা অজুহাতে বেশি মুনাফা করে ভোক্তার পকেট হাতিয়ে নিয়েছেন আরও কয়েক হাজার কোটি টাকা। প্রণোদনা, ঋণপত্র খোলা, ব্যাংকঋণসহ আরও বিভিন্নভাবে সরকারি সুবিধা তো আছেই। অসহায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, নামমাত্র অভিযান আর আমদানির হুমকি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে। আর ব্যবসায়ী চক্রের অতিলাভের চাপায় পড়ে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। দামের কারণে ব্যয় কমাতে অনেকে তালিকা কাটছাঁট করছেন। বাজারে নৈরাজ্যের জন্য অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা ও একটি চক্রের কারসাজিকে দায়ী করেছেন। 


বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে জানা যায়, গত দুই বছরে মানুষের আয় না বাড়লেও এ সময়ে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৭ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ দুই বছর আগে মানুষ কোনো পণ্য ১০০ টাকায় কিনলেও এ বছরের জুলাই মাসে ওই একই পণ্য তাকে ১১৭ টাকায় কিনতে হয়েছে। এটা হলো সরকারি হিসাব। বাস্তবে মূল্যস্ফীতি আরও অনেক বেশি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ত্যক্ত-বিরক্ত-ক্ষুব্ধ হলেও বাজার ব্যবস্থাপনা, পণ্যের দাম আর ব্যবসায়ীদের মর্জির ওপর অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া কার্যত মানুষের আর যেন কিছুই করার নেই। 


মানুষের কষ্টের জীবনের খণ্ডচিত্র 

বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা মো. আবদুর রহিম (ছদ্মনাম)। বেতন পান ৮০ হাজার টাকা। দুই ছেলে, স্ত্রী ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে থাকেন রাজধানীর মগবাজারে। জীবনযাত্রার ব্যয় এত বেড়েছে যে এ টাকায় এখন আর কুলাতে পারছেন না। প্রতি মাসেই ধার করতে হচ্ছে। বাসাভাড়া ২৫ হাজার টাকা। বড় ছেলের প্রতি মাসের সেমিস্টার ফি ১০ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াতসহ হাতখরচ ৬ হাজার টাকা। ছোট ছেলের যাতায়াত খরচসহ স্কুল ফি ৭ হাজার টাকা। মায়ের চিকিৎসা ও ওষুধে খরচ ১৩ হাজার টাকা। চালে খরচ প্রায় ২ হাজার ৬০০ টাকা। মাছ-মাংস-ডিম-সবজিসহ যাবতীয় মুদি মালে খরচ ১৫ হাজার টাকা। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও ডিশ-ইন্টারনেট বিল ৮ হাজার টাকা। এতেই বেতনের টাকা শেষ। নিজের যাতায়াত, হাতখরচ, স্টেশনারি তো আছেই। ঘাটতি মেটাতে তিনি এখন একটি এফডিআর ভেঙে খাচ্ছেন। আবদুর রহিমের মতো এ রকম অসংখ্য মানুষের গল্প প্রায় একই রকম। এখন আর মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র মানুষ বলে নয়, প্রায় সবাই নিত্যপণ্যের বাড়তি দামের চাপে পিষ্ট হচ্ছেন। 


কতটা অনিয়ন্ত্রিত বাজার 

ডিমের ডজন রেকর্ড ১৬০-১৭০ টাকায় ওঠানামা করছে। আলুর বাম্পার ফলনে সরবরাহ-মজুতে কোনো ঘাটতি নেই; অথচ কেজিপ্রতি দাম ঠেকেছে ৪০-৪৫ টাকায়। কাঁচা মরিচ থেকে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, তেল, চিনি, মাছ, মাংস প্রায় সব পণ্যের দামই এখন নির্ধারিত হচ্ছে বিক্রেতাদের ইচ্ছেমতো। শুল্ক-কর, প্রণোদনাসহ সব সরকারি সুবিধা নিয়ে ব্যবসায়ীরা এখন রীতিমতো বেপরোয়া। আজ পেঁয়াজের দাম বাড়ে তো, কাল আলুর দাম। এভাবে শ্বাস নেওয়ার আগেই দামের নৈরাজ্য ভোক্তার দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হচ্ছে। পণ্যের দাম বাড়লেই কেবল জাতীয় ভোক্তা-অধিকার অধিদপ্তর রাজধানীর দু-একটি বাজারে অভিযানে যায়। কয়েক হাজার টাকা জরিমানা ছাড়া তেমন কোনো শাস্তি হয় না দায়ী ব্যবসায়ীদের। বাজার সহনীয় রাখতে কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন ও সেবা খাত; বিশেষ করে কৃষি, পোলট্রি, মৎস্য, ভোজ্যতেল, চিনি, পশুপালনসহ বিভিন্ন খাত মোট ২৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব-সুবিধা নিয়েছে গত দুই বছরে। অথচ বাজার আগের চেয়ে আরও নিয়ন্ত্রণহীন হয়েছে। 


ব্যবসায়ীরা কী কী সুবিধা পান 

ডিম আমদানি হয়ে আসে না। শুল্ক-কর দিতে হয় না। পোলট্রিশিল্প খাত কর অবকাশ ভোগ করছে। শুধু তা-ই নয়; পোলট্রিশিল্পের কাঁচামাল মাত্র ১ শতাংশ শুল্কে আমদানি করে। কয়েকটি করপোরেট সিন্ডিকেট পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা একদিকে শুল্ক-করের সুবিধা নিচ্ছে, অন্যদিকে বিশেষ কারণ ছাড়াই সপ্তাহের ব্যবধানে ডজনে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে। ওই ব্যবসায়ী চক্রটির নেপথ্যে কোন শক্তি কাজ করছে–ভোক্তা মহলে এমন প্রশ্ন উঠলেও দায়িত্বশীল কোনো মহল থেকেই এর জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। জানা যায়, দুই বছরে পোলট্রি ও মৎস্য খাত ১০ হাজার কোটি টাকার ছাড় পেয়েছে। পশুখাদ্য, কৃষি যন্ত্রপাতি ও কীটনাশকে ছাড় ৩ হাজার কোটি টাকা। 


ভোজ্যতেল আমদানিনির্ভর। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে পণ্যটির দাম বেড়েছিল। তবে এখন তা অনেক কমে গেছে। বিশ্ববাজারে যে হারে কমেছে, দেশে কমেছে নামমাত্র। অথচ শুল্ক-কর ছাড় দিলে পণ্যটি মানুষের হাতের নাগালে থাকবে বলে বিশেষ সুবিধা নিয়েছিলেন আমদানিকারকেরা। গত দুই বছরে ভোজ্যতেলেই ছাড় দেওয়া হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। অন্তত এই ছাড়ের সুফল মানুষ পাওয়ার কথা। উল্টো এ সময়ে মানুষকে পণ্যটি কিনতে হয়েছে বেশি দামে। চিনিতেও ১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ছাড় দেওয়া হয়েছে। চিনির দাম এখন প্রায় দ্বিগুণ। 


‘ভোক্তা অধিকার তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করছে। তবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, ডলার রেট, শুল্কহার, ব্যবসায়ীদের অযৌক্তিক বিষয় আমরা ঠিক করতে পারব না। আর এনবিআর যে ছাড় দেয়, তার সুফল পাওয়ার আগেই যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়।’


শেয়ার করুন