২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ০১:১৯:৫৬ পূর্বাহ্ন
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আশা-নিরাশায় বিরোধীরা
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-১১-২০২৩
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আশা-নিরাশায় বিরোধীরা

তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয়ে গেছে নির্বাচনী ট্রেনের। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সেই ট্রেনে ইতোমধ্যেই সওয়ার হয়েছে আওয়ামী লীগ। তাদের সহযাত্রী হতে প্রস্তুত জাতীয় পার্টির একাংশ, তৃণমূল বিএনপি, বিএনএফসহ কিছু দল।


অন্যদিকে রাজনীতির মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো এ তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা এ ট্রেনের যাত্রী হবে কিনা- তা এখনো অনিশ্চিত; আশা-নিরাশায় দুলছে বিরোধী শিবির। এমতাবস্থায় একদিকে সহযাত্রী বাড়াতে কৌশলী আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে বিএনপি চাইছে যে কোনো লোভ-চাপ উজিয়ে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরদার করতে। এর পাশাপাশি দলটি গণতান্ত্রিক বিশ্বের ভূমিকার দিকেও দৃষ্টি রাখছে।


ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আর বিএনপিসহ বিরোধী শিবিরের মধ্যে কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়াই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে রাজপথে চলমান আন্দোলন আরও জোরদার করতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকারবিরোধী দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। পাশাপাশি সরকারের লোভ-চাপের কাছে নতিস্বীকার করে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর কোনো নেতা যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করেন, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে। এ জন্য বিএনপির বিভিন্ন পর্যায় থেকে নিজ দল ও সমমনা দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো হয়েছে।


বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতান্ত্রিক বিশ্ব কখন কী ভূমিকা রাখবে- এর ওপর বিশেষ নজর রাখছেন দলগুলোর নেতারা। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সমমনা দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।


বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেছেন, তফসিল ঘোষণার পরও নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের একাধিক উদাহরণ আমরা দেখেছি। এমনকি তফসিল ঘোষণার পর একটি নির্বাচন সম্পূর্ণ বাতিলের উদাহরণও রয়েছে। দেশের রাজনীতি এবং আসন্ন নির্বাচন উভয়েই এখনো স্পষ্টতই সম্পূর্ণ তরল অবস্থায় রয়েছে। সময়ই বলে দেবে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র কোন দিকে যাচ্ছে।’


বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, একতরফা নির্বাচন প্রতিহত করতে জনগণ প্রাণ হাতে নিয়ে সংগ্রাম করছে। জনগণের ক্ষমতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলন সকল স্বৈরাচারের জন্য হবে সতর্কবার্তা। দেড় দশক ধরে রাজনৈতিক সংকট এখন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, মনে করেন তিনি।


বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মনে করেন, তফসিল ঘোষণার পর তাদের মধ্য বড় আশার জায়গা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একযোগে প্রত্যাখ্যান করেছে ইসি ঘোষিত তফসিল। বিদ্যমান অবস্থায় দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। উপরোক্ত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চাপ।


আবার তফসিল ঘোষণার পর সরকারবিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের মুখে হতাশার কথাও শোনা যাচ্ছে। তারা মনে করেন, গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ পণ্ডের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যাপকভাবে সরকারবিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে। ধারণার বাইরে গিয়ে তফসিল ঘোষণার পরও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। বিএনপির মহাসচিবসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য নেতারাও ঘরছাড়া, আত্মগোপনে।


এমন অবস্থায়ও ভার্চুয়ালি বৈঠক করেছেন দলটির সিনিয়রসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। তফসিল ঘোষণার পর ছোট দলগুলোর নেতারা নির্বাচন ইস্যুতে কথা বলে একে অপরের মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বোঝার চেষ্টা করছেন। আবার জামায়াতে ইসলামীও তার সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নেই। এই অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকড়সহ সরকারের কঠোর অবস্থানের মধ্যে ‘চাপ ও লোভ’ সামলে দীর্ঘ সময় সফলভাবে আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তাও দেখা দিয়েছে নেতাকর্মীদের মাঝে।


যদিও জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম বলেন, সরকারবিরোধী মানুষের জন্য আশার কথা হচ্ছে, দেশের ডান-বাম নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত বহু রাজনৈতিক দল একতরফা তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। পাশাপাশি রাজপথেও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের চরম নির্যাতনের মধ্যে সংগ্রাম করে টিকে থাকাও কঠিন। সংবিধানের দোহাই দিয়ে দেশের বড় অংশকে নির্বাচনের বাইরে রাখবেন- এটা তো গণতন্ত্র হতে পারে না।


রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিএনপি ও সমমনা দলের নেতারা মনে করেন, ভূরাজনীতি যা-ই থাকুক, ভারত, চীন ও রাশিয়া ভেতরে ভেতরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। তার বিপরীতে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ ক্ষেত্রে তফসিল ঘোষণার পর দ্রুত যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর অবস্থান দৃশ্যমান না হলে বিরোধীশিবিরের অবস্থানের মাঝে বড় ধরনের ফাটল দেখা দিতে পারে।


সরকারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এক নেতা বলেন, সবাই দেখতে চায় বাংলাদেশ ইস্যুতে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা কী হয়।


যদিও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক বিশ্বও বাংলাদেশে একটি অবাধ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র তার পলিসিও করেছে। বাংলাদেশের জনগণও রাজপথে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছে। তাই আমরা প্রত্যাশা করি, জনগণের চলমান আন্দোলনের পক্ষে গণতান্ত্রিক বিশ্ব পাশে থাকবে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাবে এবং জনগণ বিজয়ী হবে।


বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতা বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জন করায় ঘরে-বাইরে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল বিএনপি। ওই সমালোচনার জবাব দিতে খালেদা জিয়া কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। এ দুটি নির্বাচনের কোনোটিই দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ফলে সদ্যঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী বছরের সালের ৭ জানুয়ারির অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষে যৌক্তিক কোনো কারণ খুঁজে পায়নি বিএনপি।


সরকারবিরোধী নেতারাও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার বিকল্প পথ খুঁজে পাননি। তারা মনে করেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে যে কাজ করতে পারে না, তার সর্বশেষ বড় উদাহরণ হচ্ছে সর্বশেষ লক্ষ্মীপুরের উপনির্বাচন। সেখানে একটি ভোট কেন্দ্রের একটি বুথে একজন ব্যক্তি ৫৭ সেকেন্ডে ৪৩টি ভোট দিয়েছেন, বিনাবাধায় ক্ষমতাসীন দলের নৌকা প্রতীকে এ সিল মারা হয়েছে। নির্বাচনে গেলে কী হবে, এটাকে বড় উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করাচ্ছে বিরোধী দলগুলো।


যদিও গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপি দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ না নিলেও তাদের অনেক নেতা অংশ নেবেন।


এর আগের দিন বুধবার বিএনপির দুই সদস্য খন্দকার আহসান হাবিব ও একেএম ফখরুল ইসলাম নতুন জোট ‘স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চ’ গঠনের ঘোষণা দিয়ে ভোটে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন। অবশ্য এর কিছুক্ষণ পরই তাদের বহিষ্কার করে বিজ্ঞপ্তি পাঠায় বিএনপি।


এ প্রসঙ্গে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, মামলার ভয় দেখিয়ে, নানাভাবে চাপে ফেলে এবং লোভ দেখিয়ে বিএনপিসহ সমমনা দলের কিছু নেতাকে সরকার নির্বাচনে নিতে চায়।


তবে জামায়াতের একজন নেতা বলেন, নির্বাচনে নেওয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত সরকারবিরোধী কোনো দলকেই সরকার রাজি করাতে পারেনি। সমমনা দলের একজন নেতা বলেন, বিএনপি বা চলমান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কোনো দল বা নেতা নির্বাচনে গেলে স্থানীয়ভাবে তিন ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে। প্রার্থীকে প্রথমত, স্থানীয় আওয়ামী লীগ তাকে ছাড় দেবে না; দ্বিতীয়ত, বিরোধী দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা তাকে প্রতিহত করবে; তৃতীয়ত, পোলিং এজেন্ট দেওয়ার মতোও লোক পাবে না প্রার্থী। এমপি হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে না। ফলে আন্দোলনের মুখে সরকার তফসিল বাতিল করতে বাধ্য হবে।


শেয়ার করুন