দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করতে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা পদত্যাগ করছেন। গতকাল বুধবার বিকেল পর্যন্ত মোট ৬১ জন পদত্যাগ করেন। তাঁদের মধ্যে চারজন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও একজন সদস্য, ৫২ জন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, চারজন পৌরসভা মেয়র।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। এতে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে দলীয় নেতাদের ডামি প্রার্থী হতে নির্দেশনা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এমন পরিস্থিতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বাদ পড়া সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদ ও উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভা মেয়র এবং জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।
আজকের পত্রিকার জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, পদত্যাগ করা ৬১ জনের মধ্যে ১৪ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। বাকি ৪৭ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হচ্ছেন।
জনপ্রতিনিধির পদ থেকে পদত্যাগ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পদত্যাগ করে নিয়ম অনুযায়ী প্রার্থী হলে কোনো অসুবিধা নাই। আমরা একে স্বাগত জানাই। তার পরেও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক। তবে তিনি যদি দলের কেউ হন, তাহলে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা হবে আনুগত্য প্রকাশ। দলের কেউ না হলে যে কেউ দাঁড়াতে পারবেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এই জনপ্রতিনিধিরা সম্ভবত মনোনয়ন ঘোষণার দিন আওয়ামী লীগের সভাপতির বক্তব্যে অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। কারণ, তাঁরা মনে করেছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে দল থেকে সাজা বা বহিষ্কার হওয়ার আশঙ্কা এবার নেই।’
জেলা পরিষদ থেকে পদত্যাগ
জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের মধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে পদত্যাগ করেছেন হবিগঞ্জের (হবিগঞ্জ-১) মুশফিক হুসেন চৌধুরী, কুড়িগ্রামে (কুড়িগ্রাম-২) জাফর আলী এবং লালমনিরহাটে (লালমনিরহাট-৩) মতিয়ার রহমান। তাঁদের মধ্যে কুড়িগ্রাম-২ আসনে অষ্টম সংসদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরাজিত হয়েছিলেন। এরপর গত তিনটি নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে সমর্থন দিয়ে প্রার্থী দেয়নি ক্ষমতাসীনেরা। পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করে জাফর আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন,
‘জেলায় সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি দলকে আরও শক্তিশালী করার জন্য কুড়িগ্রাম সদর আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন।’
মনোনয়ন পেয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে ছাড়
১১ জন উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে পদত্যাগ করেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও পটিয়া, বগুড়ার শেরপুর ও আদমদীঘি, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, শেরপুরের শ্রীবরদী, সাতক্ষীরা সদর ও শ্যামনগর, সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার চেয়ারম্যান।
মনোনয়ন ছাড়াই পদত্যাগ ৪৭ জনের
মনোনয়ন না পেলেও ভোট করার জন্য গতকাল পর্যন্ত ৪৭ জন জনপ্রতিনিধি পদত্যাগ করেছেন। তাঁদের মধ্যে ৪২ জন উপজেলা চেয়ারম্যান, চারজন পৌরসভা মেয়র ও একজন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করে এমপি পদে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।
তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সিরাজগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ বিশ্বাস, যিনি চলতি তিন মেয়াদের প্রথমবার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। লতিফ বিশ্বাস সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বাদ পড়েন তিনি। এরপর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করে আবদুল লতিফ বিশ্বাস আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘স্থানীয় নেতা-কর্মী ও নির্বাচনী এলাকার জনগণের চাপে আমি সংসদ নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
নীলফামারী-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে পাননি সৈয়দপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিন। গত সোমবার চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন তিনি। মোখছেদুল মোমিন বলেন, ‘দলীয় মনোনয়নের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু কেন হলো না, সেটা আমার জানা নেই। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করলেও আমার বিজয় নিশ্চিত।’
নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য রূপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন শাহজাহান ভূইয়া। তিনি বলেন, ‘দল থেকে মনোনয়নপত্র না দিলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে বাধানিষেধ দেননি। সেই অনুযায়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি।’
অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, গত দু-তিন দিনে আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায় থেকে যেসব কথা শোনা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ব্যাপারটা প্রাথমিকভাবে যে রকম সোজাসুজি মনে হচ্ছিল, সেটা শেষাবধি একই রকম না-ও থাকতে পারে। সামনের দিনগুলোতে এর মধ্যে কয়েকটি ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ যোগ হতে পারে। স্বতন্ত্র প্রার্থীর কারণে দলের মধ্যে শৃঙ্খলার সংকট দেখা দিতে পারে কি না—এমন প্রশ্নে বুধবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সবকিছু মাথায় রেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং নেব।’