চট্টগ্রামে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। দলীয় ও মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং তাদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় এ বিরোধ এখন প্রকাশ্যে। নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের পর থেকে শুরু হওয়া এই রেষারেষি এখনও অব্যাহত আছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ঘটেছে সংঘাত-সহিংসতা। নির্বাচনের পর পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর বিজয়ী প্রার্থীর লোকজনের হামলার অভিযোগ যেমন আছে, তেমনি আছে প্রার্থীদের একে অপরকে দোষারোপের চেষ্টা। এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরে বিরাজ করছে চরম অস্বস্তি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে যে বিভাজন দেখা দিয়েছে, তাতে অনেক এলাকাতেই তৈরি হয়েছে সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা। এমনিতেই বিভিন্ন এলাকায় নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল ছিল আগে থেকে। নির্বাচনে দলীয় একাধিক প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে গিয়ে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সেই দূরত্ব আরও বেড়েছে। এই বিভেদ সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে। দলের ভেতরে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থেকে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তবে আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করছেন, নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর দ্বন্দ্বে সাময়িক ক্ষতি হলেও দলের মধ্যে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে না। একটা পর্যায়ে দলীয় স্বার্থে সবাই ঐক্যে ফিরবে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের বাইরে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। এর ফলে অনেক আসনেই নৌকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। অনেক এলাকাতেই দলীয় নেতাকর্মীরা প্রার্থীদের কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে পড়ে। নির্বাচনি প্রচারণা চালানোর সময় বেশ কয়েকটি আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে হামলা-পালটা হামলাসহ সংঘাত-সহিংসতা ঘটে। ভোট গ্রহণের দিন এবং এরপরও বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে ১১টিতেই ছিলেন আওয়ামী লীগের দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী যারা ছিলেন মূলত নৌকা ও লাঙ্গল প্রতীকের প্রতিদ্বন্দ্বী। এসব আসনের মধ্যে মীরসরাই, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, পটিয়াসহ বেশ কিছু এলাকায় সংঘাত হয়েছে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে।
সূত্রমতে, সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ঘটে চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে। নির্বাচনের দিন এখানে পৃথক ঘটনায় ৩০ জনের বেশি আহত হন। আসনটিতে নৌকার প্রার্থী মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন একই দলের স্বতন্ত্র মোহাম্মদ আবদুল জব্বার চৌধুরী। বিজয়ী হয়েছেন নৌকার প্রার্থী। ভোটগ্রহণের দিন এবং এর আগে-পরে বেশ ক’জন কর্মী-সমর্থক প্রতিপক্ষের হামলায় আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী।
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে নির্বাচনের আগে একাধিক হামলার ঘটনা ঘটে। এ আসনে নৌকার প্রার্থী আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী নৌকার প্রার্থী ছিলেন। তাকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের আরেক নেতা আব্দুল মোতালেব (স্বতন্ত্র)। নির্বাচনের পরও এ আসনে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা রয়েছে। রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বিজয়ী আব্দুল মোতালেব তার প্রতিদ্বন্দ্বি গত দুইবারের এমপি নদভীর দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের ঘোষণা দেন। এদিকে বিজয়ী মোতালেবের লোকজন নির্বাচন পরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালিয়েছে বলেও পালটা অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে নির্বাচনের আগে নৌকার প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী ও একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত হয়েছে। এ নিয়ে পালটাপালটি মামলাও হয়। ভোট গ্রহণের দিন মোস্তাফিজের ওপর হামলা হয়। তার গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। এখনও আসনটিতে মোস্তাফিজ ও মুজিব বলয়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা রয়েছে।
চট্টগ্রাম-১২ পটিয়ায় গত তিনবার নৌকা প্রতীক নিয়ে এমপি নির্বাচিত হওয়া সামশুল হক চৌধুরী এবার স্বতন্ত্র হিসাবে প্রার্থী হন। নৌকার প্রার্থী ছিলেন মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী। আসনটিতে নির্বাচনি প্রচার চালানোর সময় কয়েক দফায় স্বতন্ত্র প্রার্থী ও তার কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। নির্বাচনের দিন এবং এরপরেও শোভনদন্ডী ইউনিয়নে হুইপের সমর্থকদের ওপর হামলা হয়। চট্টগ্রাম-১ মীরসরাইয়েও আওয়ামী লীগের মূল প্রার্থী এবং একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া চট্টগ্রাম-১০ এ নৌকা ও ফুলকপি প্রতীকের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে দু’জন আহত হন। নগরীর বন্দর-পতেঙ্গা আসন এবং জেলার সন্দ্বীপ ও ফটিকছড়ি আসনেও নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ও দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে কিছু এলাকায় বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এতে আমরা সাময়িকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তবে আমি বিশ্বাস করি এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব তেমন একটা পড়বে না। আমরা বিভিন্ন আসনের বিজয়ী ও পরাজিত দলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলছি। বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করছি। আশা করছি ঠিক হয়ে যাবে।