সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ব্যাংককে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরেছেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান থেকে নেমে দেশে ফিরে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন তিনি।
গত ৭ মে দিবাগত রাতে তার চিকিৎসার্থে থাইল্যান্ড যাওয়া নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়েছে। দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সবার অগোচরে এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মতি বা অনুমতি ছাড়া তার যেতে পারার কথা নয়। তা সত্ত্বেও বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। কিশোরগঞ্জের এসপি ও বিমানবন্দরের কয়েকজন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তারপর তিনজন উপদেষ্টার সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। সেই তদন্ত কমিটি এখনো কোনো রিপোর্ট জমা দেয়নি, রোববার দেশে ফেরার পর সাবেক রাষ্ট্রপতি বিমানবন্দরে বা বাইরে কোনো বাধাও পাননি।
স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন ওঠে- শেখ হাসিনার সরকারের পতনের প্রায় তিন বছর আগে অবসরে যাওয়া সাবেক প্রেসিডেন্টের থাইল্যান্ড যাওয়া নিয়ে এত বিক্ষোভ, প্রতিবাদ কেন, কী উদ্দেশ্যে এবং তারপর কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাইবা নেওয়া হয়েছিল কেন?
নির্বিঘ্নে দেশ ছেড়ে একেবারে নির্বিঘ্নেই সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশে ফেরার বিষয়ে পুলিশের আইজি বাহারুল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, তাকে (আবদুল হামিদ) গ্রেপ্তার করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাহলে কীভাবে গ্রেপ্তার করবো?
শেখ হাসিনার সময়ে দুইবারের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিদেশ যাওয়ার ঘটনায় গত ৭ মে-র পর কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার হাসান চৌধুরী ও শাহজালালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তাহসিন আরিফকে প্রত্যাহার করা হয়।
এ ছাড়া আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, কিশোরগঞ্জ সদর থানার উপ-পরিদর্শক আজহারুল ইসলাম এবং পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)-র উপ-পরিদর্শক (ট্রেইনি) মো. সোলেমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এর পাশাপাশি শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সি আর আবরারকে প্রধান করে তিন উপদেষ্টার সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং নৌপরিবহন ও শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
আবদুল হামিদ কীভাবে দেশের বাইরে গেলেন, কারা এজন্য দায়ী- এসব জেনে ১৫ দিনের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা।
ওই সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, আবদুল হামিদকে দেশত্যাগে যারা সহায়তা করেছেন, তাদের কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না। তাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরত আনা হবে।
এখন অবশ্য তার বক্তব্য বদলে গেছে। একই ব্যক্তি নির্বিঘ্নে দেশে ফেরার পর এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেছেন, অনেক মামলা হয়েছে। সেগুলোর তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষে যে দোষী হবে, তাকে আইনের আওয়তায় নেওয়া হবে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এই দাবি আদায়ে চাপ সৃষ্টির জন্য প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনেও অবস্থান নেয় তারা। ১০ মে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নষিদ্ধ করা হয়। নির্বাচন কমিশনও দলটির নিবন্ধন স্থগিত করে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের বিচারের জন্য মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধন করে দলের বিচারের ধারা যুক্ত করা হয়।
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ গত ৭ মে দিবাগত রাতে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে ব্যাংকক যান। ওই সময়ের ইমিগ্রেশনের ভিডিও ফুটেজসহ সব কিছু পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনি ভিআইপি ব্যবস্থাপনায় কোনোরকম চেকিং এবং বাধা ছাড়াই লুঙ্গি পরে উড়োজাহাজে ওঠেন।
এরপর গতকাল রোববার দিবাগত রাত পৌনে দুইটায় কোনো বাধা ছাড়া লুঙ্গি পরেই শাহজালাল বিমান বন্দর হয়ে তিনি দেশে ফেরেন। তার সঙ্গে ছিলেন শ্যালক ডা. নওশাদ খান ও ছোট ছেলে রিয়াদ আহমেদ।
দেশে ফেরার পর আবদুল হামিদ তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে যাননি। ঢাকায় নিকুঞ্জের বাসায়ও তিনি ওঠেননি বলে জানা গেছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি একটি ‘বিশেষ জায়গায়’ ছিলেন। বিদেশ থেকে ফেরার পর সেখানেই ফিরে গেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, সাবেক রাষ্ট্রপতি এখনো প্রচণ্ড অসুস্থ। তিনি ক্যান্সার আক্রান্ত। ওই বিশেষ জায়গায় সাবেক রাষ্ট্রপতির স্ত্রী-ও আছেন। নিরাপত্তার কারণেই সেখানে আছেন তারা।
জুলাই আন্দোলনের সময় একটি মিছিলে হামলার ঘটনায় কিশোরগঞ্জে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সেই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকেও আসামি করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, ওই মামলায় এখনো চার্জশিট হয়নি।
আবদুল হামিদ ব্যাংকক থেকে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে (টিজি-৩৩৯) রোববার দিবাগত রাত পৌনে দুইটার দিকে দেশে ফেরেন।
বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এসএম রাগীব সামাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, আমাদের কাছে তার (অবদুল হামিদ) ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা ছিল না। কোনো গ্রেপ্তার বা ওয়ারেন্টের ব্যাপারেও আমাদের কিছু জানানো হয়নি। বিষয়টি প্রধানত দেখে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ।
ইমিগ্রেশনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, তিনি যখন দেশের বাইরে যান, তখনো তার বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। আর যখন ফিরলেন, তখনো তাকে আটক বা গ্রেপ্তারের কোনো নির্দেশনা ছিল না।