নজিরবিহীন কিছু সংকট, বিশেষ করে করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্বজুড়ে মানব সম্পদ উন্নয়নকে অন্তত পাঁচ বছর পিছিয়ে দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে নতুন অনিশ্চয়তা উসকে দেওয়া এই সংকট মানুষের গড় আয়ু, আয়, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকেও পেছনে টেনে নিয়েছে।
বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) নতুন এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কয়েক দশকের উন্নতির পর মানুষের আয়ু, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে পিছু হাঁটতে শুরু করেছে। গত ২০২০ এবং ২০২১ সালে বিশ্বের প্রতি ১০টি দেশের মধ্যে অন্তত ৯টি দেশই জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে পিছিয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবই মূলত বৈশ্বিক মানব উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী। ৩০ বছর আগে মানব উন্নয়ন সূচক প্রকাশ শুরুর পর থেকে এবারই প্রথম ইউএনডিপি এই সূচকের উল্টো পথে যাত্রা দেখেছে বলে জানিয়েছে।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউএনডিপির প্রধান আচিম স্টেইনার বলেছেন, ‘এর অর্থ আমরা আগেই মারা যাচ্ছি। আমরা কম শিক্ষা পাচ্ছি। আমাদের উপার্জনও কমছে।’
তিনি বলেন, মাত্র তিনটি মাপকাঠি দিয়ে আপনি বুঝতে পারবেন এত বেশি মানুষ কেন মরিয়া, হতাশ এবং তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত।
গত কয়েক দশক ধরেই জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে শক্তিশালী উন্নতি দেখা গেলেও ২০২০ সালে এই সূচকের অবনতি ঘটতে শুরু করে; যা চলে তার পরের বছরও। আর এর মধ্য দিয়ে গত পাঁচ বছরের মানুষের অগ্রগতি মুছে গেছে।
চলতি বছর মানব উন্নয়ন সূচকের শীর্ষে আছে সুইজারল্যান্ড। দেশটিতে মানুষের গড় আয়ু ৮৪ বছর। সুইস নাগরিকদের শিক্ষার পেছনে ব্যয় হয় গড়ে সাড়ে ১৬ বছর এবং দেশটির মানুষের গড় বেতনের পরিমাণও প্রায় ৬৬ হাজার মার্কিন ডলার।
অন্যদিকে, এই সূচকের একেবারে তলানিতে রয়েছে দক্ষিণ সুদান, যেখানে মানুষের গড় আয়ু মাত্র ৫৫ বছর। এছাড়া দেশটির নাগরিকদের শিক্ষার পেছনে গড়ে ব্যয় হয় মাত্র সাড়ে ৫ বছর। দেশটিতে মানুষের বার্ষিক গড় আয়ের পরিমাণ মাত্র ৭৬৮ ডলার।
বিশ্বের ১৯১টি দেশের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সূচকে অবনতি ঘটেছে, বিশেষ করে মানুষের গড় আয়ু কমে গেছে। এর ফলে গত ৩০ বছর ধরে উন্নয়নের যে প্রবণতা চলে আসছিল তা বিপরীতমুখী হয়েছে; যা অনেকটা ২০১৬ সালের মানব উন্নয়ন সূচকের মতো।
ইউএনডিপি মানুষের আয়ু কমে যাওয়ার উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কথা উল্লেখ করে বলেছে, ২০১৯ সাল থেকে দেশটিতে শিশুর জন্মের সময়ই আয়ু দুই বছরের বেশি কমে গেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যা আরও বেশি।
জাতিসংঘের এই সূচক চালু হওয়ার পর থেকে বছরের পর বছর ধরে অনেক দেশ নানামুখী সংকটের মুখোমুখি হয়েছে এবং তাদের সূচকেরও অবনতি ঘটেছে। কিন্তু মানব উন্নয়ন সূচকের বৈশ্বিক প্রবণতা মোটাদাগে ধারাবাহিকভাবে ইতিবাচক ছিল। কিন্তু গত বছর প্রথমবারের মতো সূচকের সব মাপকাঠিতেই অবনতি ঘটেছে এবং এই বছরেও সেই ধারা অব্যাহত আছে।
বিশ্বজুড়ে চলমান বিভিন্ন ধরনের সংকটের এখনও কোনও সমাধান হয়নি। সূচকে বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ ধনী দেশ গত বছর সূচকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলেও বেশিরভাগ দেশে তা নিম্নমুখী রয়েছে।
চলতি বছরের এই সূচক ২০২১ সালের তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউএনডিপি। আচিম স্টেইনার বলেছেন, ২০২২ সালের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশ এই মুহূর্তে তাদের জাতীয় ঋণ পরিশোধে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে।
তিনি বলেন, এই মুহূর্তে ৮০টিরও বেশি দেশ এমন এক সংকট থেকে একধাপ দূরে রয়েছে; যা অত্যন্ত গুরুতর সমস্যা তৈরি করতে পারে। আমরা গভীর প্রতিবন্ধকতা দেখছি, যার শেষ হতে আগামী কয়েক বছর লেগে যাবে।