২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ১০:৫৮:১৯ পূর্বাহ্ন
পরকীয়ার কারণেই স্ত্রীকে হত্যা করেন বাবুল আকতার
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-০৯-২০২২
পরকীয়ার কারণেই স্ত্রীকে হত্যা করেন বাবুল আকতার

চট্টগ্রামের চাঞ্চল্যকর মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলায় তার স্বামী বরখাস্তকৃত এসপি বাবুল আকতারকে প্রধান আসামি করে ৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) জমা দিয়েছে পিবিআই। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (প্রসিকিউশন) কামরুল ইসলামের কাছে মামলার চার্জশিটসহ কেস ডকেট ভর্তি লাগেজ হস্তান্তর করেন তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক ওমর ফারুক। তার সঙ্গে ছিলেন ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চল প্রধান এসপি নাঈমা সুলতানা।

লাগেজের ওপরে লাগানো ছিল মিতুর ছবি। লেখা ছিল মিতু হত্যা মামলার কেস ডকেট। যে কেস ডকেট দেওয়া হয়েছে তা ২০৮৪ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে মূল চার্জশিট হচ্ছে ২০ পৃষ্ঠার। আর আলামত রয়েছে ২১ ধরনের। ৯৭ জনকে করা হয়েছে মামলার সাক্ষী।

চার্জশিটে মিতু হত্যার পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা হিসাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে বাবুল আকতারকে। মামলায় অপর যে ৬ জনকে আসামি করা হয়েছে, তারা হলেন- কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসা সিকদার, এহতেশামুল হক ভোলা, মোহাম্মদ মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, আনোয়ার হোসেন, খায়রুল ইসলাম কালু ও শাহজাহান মিয়া। এর মধ্যে কামরুল ইসলাম সিকদার মুসা ও খাইরুল ইসলামকে পলাতক দেখানো হয়েছে। এহতেশামুল হক ভোলা রয়েছেন জামিনে। আর বাবুল আকতারসহ অপর চার আসামি কারাগারে রয়েছেন।

বাবুল আকতার বর্তমানে ফেনী কারাগারে এবং চার্জশিটভুক্ত অপর তিন আসামি চট্টগ্রাম কারাগারে রয়েছেন। এছাড়া মামলার তদন্ত চলাকালে আটক অন্য চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় তাদের চার্জশিট থেকে নট সেন্টাপ (অব্যাহতি) করা হয়েছে।’ এই চারজন হচ্ছেন- সাইদুল ইসলাম সিকদার সাক্ষু, নুরুন্নবী, রাশেদ ও গুইন্না। এরমধ্যে দুজন- নুরুন্নবী ও রাশেদ কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

চার্জশিট জমা দেওয়া প্রসঙ্গে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের এসপি নাঈমা সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, ‘মামলায় যার যতটুকু সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে ততটুকু চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে। বাবুল আকতারকে প্রধান আসামি করে ৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট প্রসিকিউশনে জমা দিয়েছি। তবে এর বাইরে বেশি কিছু বলা এই মুহূর্তে সমীচীন হবে না। পরবর্তী সিদ্ধান্ত বা কার্যক্রম আদালত নেবেন।’

অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (প্রসিকিউশন) কামরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘মিতু হত্যাকাণ্ডের অভিযোগপত্র পিবিআই আমাদের কাছে জমা দিয়েছে। আমরা আগামীকাল (বুধবার) আদালতে উপস্থাপন করব। এরপর আদালত চার্জশিট পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেবেন। চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতে ১০ অক্টোবর মিতু হত্যা মামলার নির্ধারিত তারিখ ধার্য রয়েছে।’

পিবিআই দীর্ঘ তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী চার্জশিটে উল্লে­খ করেছে, গায়ত্রী অমর সিং নামের বিদেশি এক এনজিও সংস্থার নারী কর্মীর সঙ্গে পরকীয়ার জেরে বাবুল আকতার ‘পথের কাঁটা’ দূর করতে স্ত্রী মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এজন্য তিনি ৩ লাখ টাকায় ভাড়া করেন খুনি। তার বিশ্বস্ত সোর্স কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসা ছিলেন কিলিং মিশনের প্রধান। খুনের জন্য এ মুসাকে ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল ইসলামের মাধ্যমে ৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেন বাবুল আকতার। মিতুকে যে অস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয়েছিল সেই অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন এহতেশামুল হক ভোলা নামে বাবুলের অপর সোর্স। হত্যাকাণ্ডের পর ভোলার হেফাজত থেকে সেই অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা গুলি ব্যালাস্টিক পরীক্ষায় মিলে গেছে।

আদালতে একাধিক আসামির ১৬৪ ধারার জবানবন্দি, পরকীয়া সংক্রান্ত বিদেশি এনজিওকর্মী গায়ত্রী ও বাবুলের হাতের লেখা ডায়েরি তথা আলামত উদ্ধারসহ সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে পিবিআই বাবুল আকতারকে প্রধান আসামি করে ৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট প্রস্তুত করে। সেই চার্জশিটের সাক্ষ্য স্মারকলিপি বা এমই (মেমোরেন্ডাম অব এভিডেন্স) প্রথমে স্বাক্ষর করেছেন মহানগর পিপি ফখরুদ্দিন চৌধুরী। তিনি ওই তদন্তকে যথাযথ ও সুনিপুণ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। পিবিআইর হেডকোয়ার্টারের অনুমোদনের পর মঙ্গলবার চার্জশিট তথা কেস ডকেট আদালতে উপস্থাপনের জন্য এডিসি প্রসিকিউশনের হাতে তুলে দেওয়া হলো। আর এর মাধ্যমেই চাঞ্চল্যকার মিতু হত্যা মামলার দীর্ঘ প্রায় ৬ বছরের তদন্ত সম্পন্ন হলো।

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ওআর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার কাছে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয় মাহমুদা খানম মিতুকে। স্ত্রীকে খুনের ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তরের তৎকালীন এসপি বাবুল আকতার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে। গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদসহ নানা নাটকীয়তার পর ওই বছরের আগস্টে বাবুল আকতারকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

বাবুল আকতারকে উপহার দেওয়া একটি বইয়ের লেখার সূত্র ধরে মামলার মোড় ঘুরে যায় বলে জানান তদন্তসংশ্লিষ্টরা। ২০১৩ সালে কক্সবাজার জেলা পুলিশে কর্মরত থাকার সময় বাবুলের সঙ্গে সেখানে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত গায়ত্রী অমর সিংয়ের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। গায়ত্রী বাবুলকে ইংরেজি ভাষায় লিখিত ‘তালিবান’ নামের একটি বই উপহার দেন। ওই বইয়ের তৃতীয় পাতায় গায়ত্রী অমর সিংয়ের নিজ হাতে লেখা এবং শেষ পাতা ২৭৬-এর পরের খালি পাতাটিতে বাবুল আকতারের হাতে লেখা ইংরেজিতে তাদের ‘প্রথম সাক্ষাত’র বিষয়সহ রোমান্সকর বিভিন্ন মুহূর্তের কিছু বিবরণ লেখা ছিল।

তদন্তকালে পিবিআইর কাছে গ্রেফতার ভোলা, ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে মিতু হত্যার দায় স্বীকার করেন। এর মধ্যে ভোলা তার জবানবন্দিতে অপর আসামি মুসার সঙ্গে কথোপকথনের বিষয় উল্লে­খ করেন। সেখানে বাবুল আকতার যে মুসাকে তার (বাবুল আক্তারের) স্ত্রীকে হত্যার বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন সেটি উলে­খ আছে। তাছাড়া সাইফুল ইসলাম নামে নিজের এক ব্যবসায়িক অংশীদারের মাধ্যমে বাবুল আকতার তার স্ত্রী মিতুকে হত্যার জন্য ৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন সেটিও জবানবন্দিতে এসেছে।

হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে স্বয়ং বাবুল আকতারের সম্পৃক্ততার বিষয়টি আসামিদের জবানবন্দি ও তথ্য প্রমাণে উঠে আসায় ২০২১ সালের ১১ মে বাবুল আকতারকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। পরদিন বাবুল আকতারের মামলায় আদালতে ৫৭৫ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। ওই বছরের ১২ মে বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় বাবুল আকতারসহ আটজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।

চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতের পর্যবেক্ষণ মেনে মোশাররফের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। একইসঙ্গে ওই মামলার ডকেট প্রথম মামলার সঙ্গে সংযুক্ত করে তদন্তের জন্য আবেদন করেন। আদালত অনুমতি দিলে শুধু বাবুল আকতারের করা মামলাটির তদন্তই চলমান থাকে। এখন বাবুল আকতারের করা মামলায় বাবুল আকতারকেই চার্জশিটে প্রধান আসামি করা হলো। অর্থাৎ স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলায় বাদী থেকে আসামি হলেন বাবুল আকতার। 

শেয়ার করুন