২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৪:১৪:১৪ অপরাহ্ন
ঘুস ছাড়া নড়ে না ফাইল
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-১০-২০২২
ঘুস ছাড়া নড়ে না ফাইল

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক, উপ-পরিচালক ও সহকারি পরিচালকের বিরুদ্ধে ঘুস বাণিজ্যের অভিযোগ পুরনো। ফাইল আটকে ঘুস আদায় করেন তারা। এ নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রধানরাসহ শিক্ষকরা গত দুই বছর ধরে সচিবসহ অনেকের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। এবার কলেজ শাখার উপ-পরিচালক মাহাবুবুর রহমানের ঘুসের দরদাম সংক্রান্ত একটি অডিও ফাঁস হয়েছে।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার একটি কলেজের শিক্ষক তার বোনের মেয়ের এমপিও ছাড়করণের জন্য সম্প্রতি ফোন করেন ডিডি মাহাবুবুর রহমানকে। ফোনালাপে শিক্ষা কর্মকর্তা ওই কলেজ শিক্ষককে বলেন ‘ আমি তো ওই ফাইল ছেড়ে দিব। কিন্তু আপনিতো পরিচালক-সহকারী পরিচালক সম্পর্কে সবই জানেন। উত্তরে শিক্ষক বলেন, জ্বি জ্বি স্যার। এরপর ডিডি বলেন, ‘তো তারা এমনি এমনি কাজ করতে চায় না। এটা মূল সমস্যা। এর জন্য আপনাকে কিছু সেক্রিফাইস করতে হবে। ওটা করলেই কাজটা হয়ে যাবে।’ জবাবে শিক্ষক বলেন, ‘জ্বি স্যার জি স্যার।’

অভিযোগ রয়েছে, এভাবে নিজের ক্ষমতাবলে অথবা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে গত ১০ মাসেই রাজশাহী বিভাগের আটটি জেলার শতাধিক কলেজ শিক্ষক-কর্মচারির এমপিওর আবেদন ফাইল আটকে রেখে কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য করেছেন উপ-পরিচালক মাহাবুবুর রহমান।

পাবনার ঈশ্বরর্দী উপজেলার বাঁশেরবাদা কলেজের সাত শিক্ষকের কাছ থেকে এমপিও বাবদ আদায় করা হয়েছে অন্তত: সাত লাখ টাকা। ওই শিক্ষকরা একযোগে টাকা তুলে তা মাহাবুবুর রহমানকে দিয়েছেন বলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক বলেন, ‘টাকা নিয়ে একদিনেই সাত ফাইল ছাড় করেছেন উপ-পরিচালক। সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরেও তাদেরকে টাকা দিতে হয়েছে। কোন উপায় ছিল না।’

জানা যায়, রাজশাহী বিভাগের আট জেলার কলেজ শিক্ষক- কর্মচারির এমপিওসহ আনুসঙ্গিক সুবিধাদি নিশ্চিতে মাউশির রাজশাহী অফিসে পরিচালক, সহকারি পরিচালক ও উপপরিচালক দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকদের কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে পরিচালকের অনুমোদন সাপেক্ষে মাউশির সার্ভারে পাঠানো হয়। মাউশির পরিচালক অধ্যাপক কামাল হোসেন, সহকারি পরিচালক আবু রেজা আজাদ ও উপপরিচালক মাহাবুবুর রহমান অনেকদিন ধরেই জোটবদ্ধভাবে ঘুষ আদায় করে আসছেন। গত জুলাই মাসে শিক্ষা সচিব রাজশাহীতে এলে শিক্ষক সমিতির নেতারা পরিচালকসহ চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তার কাছে সরাসরি অভিযোগ করেন।

ভুক্তভোগী শিক্ষকরা জানান, ফাইলে কোন ক্রটি না থাকলেও এই তিন কর্মকর্তা টাকা না পেলে ৩ থেকে ৫ মাস পর্যন্ত আটকে রাখেন। আর ঘুষ আদায়ের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে আসছেন সহকারি পরিচালক ও উপপরিচালক। নিচ থেকে সঙ্কেত না পেলে পরিচালক কোন ফাইলে চূড়ান্ত অনুমোদন দেন না। রাজশাহীর দুর্গাপুরের একটি কলেজের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমার ফাইলে কোনো ত্রুটি ছিল না। দুই মাস পর টাকার বিনিময়ে ছাড় করেন উপ-পরিচালক মাহাবুবুর রহমান শাহ। পরিচালকের কাছে অভিযোগ করেও কোন লাভ হয়নি। শেষে টাকা দিয়েই ফাইল ছাড়াতে হয়েছিল।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এমপিও আবেদনকারী শিক্ষকদের ফাইল জমা হলে তাদেরকে ফোনে ডেকে এনে টাকা আদায় করেন থাকেন উপপরিচালক। তাকে সহযোগিতা করেন আরও দুই সহকারী পরিচালক ও সহকারী পরিদর্শক আসমত আলী। এই অরাজকতা অনেকদিন ধরেই মাউশির রাজশাহী অঞ্চল অফিসে চলছে।

পাবনার একটি কলেজের শিক্ষক জহিরুল ইসলামের কাগজপত্রে ত্রুটি ছিল না। গত ১৫ এপ্রিল সহকারী পরিচালক আবু রেজা আজাদ ছাড় করেন। এর তিন মাস পর ৭ জুলাই ছাড় করেন উপপরিচালক। ওই কলেজের আরও চারজন শিক্ষকের ফাইল একইভাবে আটকিয়ে রাখেন তিনি। পাবনার গুরুদাসপুর কলেজের একজন শিক্ষকের ফাইল ৫ মাস উপপরিচালক আটকিয়ে রেখে সেটি অনুমোদন করেন ১ জুলাই। এভাবে চলতি বছরেই অন্তত: শতাধিক ফাইল আটকে রেখে তিনি বিপুল অর্থ বাণিজ্য করেছেন।

অভিযোগ অস্বীকার করে উপপরিচালক মাহাবুবুর রহমান শাহ বলেন, কাজের প্রচুর চাপ থাকে। যে শিক্ষকের সঙ্গে আমার কথোপকথনের অডিও’র কথা বলা হচ্ছে তার ফাইলটি আগেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সিস্টেমের কারণে কিছু বিলম্ব হয়। ঘুষ আদায়ের অভিযোগ একেবারেই ঠিক নয়।

মাউশির রাজশাহী অঞ্চলের পরিচালক অধ্যাপক কামাল হোসেন বলেন, ‘আমার কাছে কোনো ফাইল আটকে থাকার সুযোগ নাই। উপপরিচালক যেসব ফাইল অনুমোদন করে আমার কাছে পাঠান, আমি ওইদিনই সেগুলো অনুমোদন দিয়ে ডিজি অফিসের সার্ভারে দিয়ে দিই। তবে তিনি স্বীকার করেন কিছু অভিযোগে এই উপপরিচালককে কয়েকবার শোকজ করা হয়েছিল।

শেয়ার করুন