দেশজুড়ে যখন বিদ্যুৎ সংকট চরমে তখন সংশ্লিষ্ট সবার সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সঞ্চালন লাইন। শুধু সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না হওয়ার কারণে উৎপাদনের পরও জাতীয় গ্রিডে যোগ করা যাচ্ছিল না পায়রা বিদ্যুতকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ। শংকায় ছিল রামপালের বিদ্যুৎ নিয়েও। তবে এবার কেটে যাচ্ছে সব শঙ্কা। পদ্মার ওপর দিয়ে কাজ শেষে প্রস্তুত হয়ে গেছে আমিনবাজার-গোপালগঞ্জের সঞ্চালন লাইন।
৪০০ কেভির ডাবল সার্কিট লাইনটির উদ্বোধন হবে আজ বৃহস্পতিবার। চার লাখ ভোল্টেজ দিয়ে চালু করে লাইনটি উচ্চ ভোল্টেজে ৪০০ কেভিতে বিদ্যুতায়িত করা হবে। এটির সফলভাবে উদ্বোধন হলে শুধু পায়রা নয়, রামপালের বিদ্যুৎও উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে বলে আশা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
এই তথ্য নিশ্চিত করে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) কর্মকর্তারা জানান, সঞ্চালন লাইন চালু করতে আনুষঙ্গিক বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ প্রতিস্থাপনের কাজ সফলভাবে শেষ হয়েছে। এখন চলছে টেস্টিং ও কমিশনিংয়ের কাজ। এ বিষয়ে পিজিসিবি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া সাংবাদিকদের বলেন, সব ঠিক থাকলে বৃহস্পতিবার (আজ) পরীক্ষামূলকভাবে লাইন চার্জ করা হবে।
পিজিসিবি জানায়, এই সঞ্চালন লাইন নির্মাণে মোট দুই হাজার ৫০৫ কোটি টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) দিয়েছে এক হাজার ২৭০ কোটি টাকা, সরকারের সহায়তা ৮৯৭ কোটি টাকা এবং পিজিসিবির নিজস্ব অর্থায়ন রয়েছে ৩৩৭ কোটি টাকা।
এদিকে লাইনটি চালুর বিষয়ে ইতোমধ্যে একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে পিজিসিবি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৫ ডিসেম্বর (আজ) দুপুর ১২টায় চালু করা হবে সঞ্চালন লাইনটি। চার লাখ ভোল্টেজ দিয়ে চালু করে লাইনটি উচ্চ ভোল্টেজে ৪০০ কেভিতে বিদ্যুতায়িত থাকবে। এ সময় সঞ্চালন লাইনের টাওয়ারে আরোহণ, গবাদিপশু বাঁধা, রশি টাঙিয়ে কাপড় ঝোলানো থেকে বিরত থাকতে আহ্বান করে পিজিসিবি।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গোপালগঞ্জ থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত সঞ্চালন লাইনটি মূলত ‘আমিনবাজার-মাওয়া-মোংলা ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট লাইন’ প্রকল্পের অংশ। ১৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সঞ্চালন লাইনটিতে মোট ৯.৪ কিলোমিটার নদী ক্রসিং রয়েছে। যার মধ্যে আছে পদ্মা নদী ক্রসিং। লাইনটি নির্মাণের উদ্দেশ্য হলো, রামপাল ও পটুয়াখালীর পায়রায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ ঢাকায় নিয়ে আসা।
তবে শুধু পায়রা নয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মায় সঞ্চালন লাইনের কাজ এমন সময় শেষ হয়েছে, যখন বাগেরহাটের রামপালে নির্মাণাধীন এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর তোড়জোড় চলছে। চলতি মাসের শেষ দিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট (৬৬০) মেগাওয়াট সম্ভাব্য বাণিজ্যিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগোচ্ছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)।
গত এক যুগে দেশে বিদ্যুৎ সক্ষমতা ছাড়িয়েছে ২০ হাজার মেগাওয়াটের উপরে। ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ এ সংখ্যা ২৫ হাজার ৭৩০ মেগাওয়াটের উপরে। এসময় নতুন করে ১২৭ বিদ্যুতকেন্দ্রও নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সক্ষমতা ও চাহিদার বিপরীতে সঞ্চালন লাইন ছিল একেবারেই নগন্য। দেশে ১৯৮টি গ্রিড উপকেন্দ্রে কনভারশন ক্ষমতা প্রায় ৫২ হাজার ৬৭৯ হাজার ৫১৬ মেগাওয়াট।
এর বিপরীতে সঞ্চালন লাইন ছিল মাত্র ১৩ হাজার ৮৮৯ সার্কিট কিলোমিটার। ফলে বড় বড় কেন্দ্র চালু হলেও শুধু সঞ্চালন লাইন না থাকার কারণে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যাচ্ছিল না। এই প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি সঞ্চালন লাইনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বানের বিপরীতে এই কর্মতৎপরতা জানিয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা আশা করেছিলাম সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে ভারত থেকে আমদানি করা আদানির বিদ্যুৎ।
কিন্তু সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না থাকায় এটি পিছিয়ে গেছে। আশা করছি আগামী বছরের শুরুতেই এটি পাওয়া যাবে। তবে আমাদের পায়রা-গোপালগঞ্জ-আমিনবাজার ৪০০ কিলো ভোল্ট (কেভি) ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইনের কাজ পুরোপুরি শেষ। আশা করছি এর উদ্বোধন হলে পায়রার বিদ্যুৎ আমরা পাব। একই সঙ্গে রামপালের বিদ্যুৎও আনা যাবে এই সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে।
এবার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইনের দিকে নজর দেওয়ার আহ্বান জানান বিশেষজ্ঞরা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা যতদূর জেনেছি রূপপুরের সঞ্চালন লাইন তৈরির কাজ একবিন্দু এগোয় নি। তাই এটি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হলেও তা জাতীয় গ্রিডে যোগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যেহেতু দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত আমিনবাজার গোপালগঞ্জ সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত হয়েছে এবার পিজিসিবি’র উচিত হবে রূপপূরের সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত করার জন্য তৎপর হওয়া।
তবে নতুন বছরে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করে মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালিয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় তা সরাসরি চলে যায় গোপালগঞ্জে। সেখান থেকে বিতরণ হয় তাদের সাবস্টেশনে। মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পর্যন্ত এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। আমরা আশা করেছিলাম সেপ্টেম্বরের মধ্যেই এই সঞ্চালন লাইনটি প্রস্তুত হয়ে যাবে। ফলে এখান থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করতে পারব। কিন্তু এখন একটু দেরি হয়ে গেল।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) বলছে, বিতরণ সংস্থা পর্যন্ত বিদ্যুৎ পৌঁছাতে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা নিরসনে প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ২১টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কার্যক্রম ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারীসহ নানা জটিলতায় তা পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হয়নি।
শুধু তাই নয়, এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষে বর্তমান সক্ষমতার সঙ্গে আরও নতুন ১১৭টি গ্রিড উপকেন্দ্র সংযুক্ত করার কথা ছিল। আট হাজার সার্কিট কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মিত হবে। যার জন্য ২০২৮ সালকে টার্গেট করা হয়েছিল।
এ লক্ষ্যেই আরও আটটি প্রকল্প গ্রহণের উদ্যোগের কথা জানিয়ে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া বলেন, সঞ্চালন লাইনের দুর্বলতা কাটাতে গত এক দশকে ৫৪টি প্রকল্প গ্রহণ করেছে পিজিসিবি। এর মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে ২৫টি। চলমান রয়েছে ২১টি প্রকল্পের কাজ। আরো আটটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। যেগুলোর মেয়াদ শেষ হবে ২০২৮ সাল নাগাদ।
চলমান ও পরিকল্পনাধীন প্রকল্পগুলো শেষ হলে দেশে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দুর্বলতা কাটবে অনেকটাই কেটে যাবে বলে আমরা আশা করছি। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের প্রতিবন্ধকার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এসব প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও সঞ্চালন লাইন নির্মাণের রাইট অব ওয়ে প্রাপ্তিসহ সামগ্রিক প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পিজিসিবি এসব সীমাবদ্ধতা দূর করতে অন্তবর্তীকালীন কার্যক্রম এবং স্থায়ীভাবে দূর করতে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। যেগুলো দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়িত হবে।