দেশ থেকে প্রতিবছর অন্তত ৭১ হাজার কোটি টাকা পাচার হলেও তা প্রতিরোধ বা পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অর্থ পাচার ঠেকাতে কার্যত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে সংস্থাটি। কিন্তু দেশের দুর্নীতিবিরোধী একমাত্র স্বাধীন এ প্রতিষ্ঠানটি কেন ব্যর্থ হচ্ছে-সে বিষয়টি নিজেদের প্রতিবেদনেই তুলে ধরা হয়েছে।
দুদক বলছে, তাদের হাতে অর্থ পাচারসংক্রান্ত ২৭টি অপরাধের মধ্যে মাত্র একটি অপরাধের তদন্ত ও অনুসন্ধানের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তাও আবার ঘুস ও দুর্নীতি। যা বিধি অনুযায়ী এমনিতেই দুদকের করার কথা। এ ক্ষেত্রে সংস্থাটি মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারসংক্রান্ত অপরাধ তদন্তের আওতার বাইরে রয়েছে। সেজন্য তারা অর্থ পাচারে জড়িত অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি অর্থ পাচারসংক্রান্ত ৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্তের এখতিয়ার চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছে। রাষ্ট্রপতির কাছে দাখিলের জন্য প্রস্তুত করা ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দুদক তাদের এই সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে অর্থ পাচারে জড়িতদের ধরতে বাড়তি ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনে একই সঙ্গে দেশের দুর্নীতির ভয়াবহতার চিত্রও তুলে ধরা হয়।
দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহর স্বাক্ষরে এই প্রতিবেদন ২০ মার্চ রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের কাছে দাখিল করা হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্নীতির ভয়াবহতার সার্বিক চিত্র দেখে মনে হচ্ছে, সমাজে অবৈধ সম্পদ গড়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এমনকি দুর্নীতির ব্যাপারে মানুষের মনোভাব ও সামাজিক অবস্থায়ও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আগে দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে কেউ আত্মীয়তা করতে চাইত না। কিন্তু এখন মানুষের মর্যাদা নিরূপণ হয় অর্থের মাপকাঠিতে। যা অত্যন্ত হতাশার।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ এবং বিশ্বায়নের ফলে দুর্নীতির ক্ষেত্রে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বদলেছে দুর্নীতির ধরন ও প্রকৃতি। দেশের সেবা খাতে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ যেমন বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে দুর্নীতি। এই দুর্নীতি শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, আগ্রাসী হয়েছে বিশ্বব্যাপী। হুন্ডি, ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং, পানামা পেপারস, প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারি, সেকেন্ড হোম প্রজেক্ট, বেগমবাড়ী, ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং শেল ব্যাংকিং কোম্পানিসহ নতুন নতুন অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে দুর্নীতির ক্ষেত্রে। এসব ক্ষেত্র ব্যবহার করে ছদ্মবেশে বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। যা প্রতিরোধ করা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।
অর্থ পাচার বিষয়ে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দুর্নীতির পরিধি দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছে। ঋণখেলাপি ও দুর্নীতিবাজরা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদক আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লিয়াজোঁ বৃদ্ধির চেষ্টা করে যাচ্ছে। অর্থ পাচার তদন্তে সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থ পাচার হলেও দুদক সব ধরনের অর্থ পাচারের অনুসন্ধান বা তদন্ত করতে পারছে না। ২০১৫ সালে সংশোধিত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচারসংক্রান্ত ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে দুদককে মাত্র একটি অপরাধের (ঘুস ও দুর্নীতি) ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এর ফলে দুদক অর্থ পাচার মামলার ক্ষেত্রে আগের মতো সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারছে না। দুদক যাতে পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে অধিকতর ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সেজন্য ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং আইন এবং ২০১৯ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা সংশোধনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। যাতে আরও ৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের অনুসন্ধান ও তদন্তের এখতিয়ার অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি দুদককেও দেওয়া হয়। অপরাধগুলো হচ্ছে-দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাচার, শুল্কসংক্রান্ত অপরাধ, কর অপরাধ, পুঁজিবাজারসংক্রান্ত অপরাধ, দলিল-দস্তাবেজ জালকরণবিষয়ক অপরাধ, প্রতারণা এবং জালিয়াতি। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মানি লন্ডারিং কেস জটিল প্রকৃতির। কোনো এক দেশে সংঘটিত অপরাধ যে দেশের কাছে রেকর্ড চাওয়া হয়, সে দেশে অপরাধ না হলে রেকর্ড পাওয়া যায় না। এমএলএআর (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স ট্রিয়েটি) করার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য লাগে। না হলে রেকর্ড পাওয়া যায় না। এ সমস্যা সমাধানের জন্য দুদক পারস্পরিক আইনি সহায়তা চুক্তি।
ইতোমধ্যে কানাডা, যুক্তরাাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও থাইল্যান্ড থেকে সাক্ষ্যপ্রমাণ, রেকর্ডপত্র সংগ্রহ, পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে পারস্পরিক আইনি সহায়তা চুক্তি (এমএলএআর) করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে অনুরোধ করা হয়েছে।
পাশাপাশি দুদক দেশে দুর্নীতি রোধে ইউনাইটেড নেশন্স কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট করাপশনের (ইউএনসিএসি) ৪৮ অনুচ্ছেদের নির্দেশনা অনুসরণ করে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে অংশীদারত্বমূলক সম্পর্কের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলোর পর্যবেক্ষণ বলছে, দুদক প্রতিষ্ঠার পর ১৮ বছর ধরে সংস্থাটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করলেও আশানুরূপ ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। রাষ্ট্র ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রবেশ করে সবকিছু নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
দুদকের প্রতিবেদনেও বলা হয়, সরকার বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করলেও সমানতালে বৃদ্ধি পেয়েছে দুর্নীতি। অথচ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন সোনার বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তার অন্তরায় হচ্ছে এই ভয়াবহ দুর্নীতি।
এই লাগামহীন দুর্নীতি ঠেকাতে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতিবিরোধী কর্মপরিকল্পনা, আইন ও বিধি প্রণয়ন-এমনকি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গড়ে তোলা হলেও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এখন পর্যন্ত যৌক্তিক পর্যায়ে দুর্নীতি কমিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দেশের মানুষ এখন দুর্নীতিকে নিত্যদিনের অনুষঙ্গ হিসাবে মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যেখানে ধর্মপ্রাণ, সেখানে দুর্নীতির এত ব্যাপকতা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘুস ও দুর্নীতির অনেক ক্ষেত্রেই উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য। কারণ ঘুস-দুর্নীতির ক্ষেত্রে উভয়পক্ষই সুবিধাভোগী। শুধু বঞ্চিত হয় রাষ্ট্র ও সমাজ।
দুদক মনে করে, সংবিধানে দেওয়া ম্যানডেট অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ ভোগ করতে না দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারা এবং দেশের বাইরে অর্থ পাচার রোধ করা সম্ভব হলে দেশে আশানুরূপ দুর্নীতি দমন করা সম্ভব হবে।
এতে আরও বলা হয়, জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যের ১৬নং লক্ষ্যটি সরাসরি দুর্নীতি দমনের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এসডিজির (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) ১৭টি লক্ষ্য পূরণেই দুর্নীতির ঋণাÍক ভূমিকা পালন করার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্পদের ওপর ব্যক্তির মালিকানা অর্জন এবং মানুষের সাধ ও সাধ্যের মধ্যে অসঙ্গতি রয়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ নির্মাণে কাল্পনিক স্বপ্নে বিভোর কতিপয় মানুষের সীমাহীন লোভ দুর্নীতির অন্যতম কারণ। আর দুর্নীতি এমনই এক সমস্যা যা দেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জাতির নৈতিক উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। দুর্নীতি কেবল গণতন্ত্রের ভিত্তিকেই দুর্বল করে না বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদকেও উৎসাহিত করে। দুদক এসব দুর্নীতি নির্মূলের লক্ষ্যে যে কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তাও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে।
২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ছাড়াও ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি, ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৫৮ সালের দ্য ক্রিমিনাল ল’ অ্যামান্ডমেন্ট অ্যাক্ট এবং ২০১২ সাল ও পরবর্তী সংশোধনীসহ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দুদক কাজ করে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনের এক অংশে বলা হয়, সাধ্যের বাইরে গিয়ে সীমাহীন সাধ মেটাতে গিয়ে মানুষ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করার প্রবণতাও দুর্নীতির অন্যতম সূতিকাগার।
২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর দুদক গঠন করা হয়। এরপর ১৮ বছর পেরিয়ে গেছে। তবে এই সময়ের মধ্যে দুর্নীতি দমনে দুদকের আশানুরূপ অর্জন নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রতিবেদনে দুদকের ২০২২ সালের কিছু কার্যক্রম তুলে ধরা হয়। এতে বিচারিক আদালতে দুদকের মামলার সাজার হার ৬৪ ভাগ বলে তথ্য জানানো হয়। তবে মানি লন্ডারিং মামলায় সাজার হার শতভাগ। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ২৯১০টি দুর্নীতির মামলার বিচারকাজ চলছে। হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত আছে ৪১৯টি মামলার বিচারকাজ।
২০২২ সালে বিভিন্ন উৎস থেকে ১৯ হাজারেরও বেশি অভিযোগ পায় দুদক। এর মধ্যে মাত্র ৯০১টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য অনুমোদন করা হয়েছে। ৩ হাজারের মতো অভিযোগ বা তদন্তের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারি দপ্তরগুলোতে পাঠানো হয়েছে।
রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করার জন্য প্রস্তুত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কতিপয় দুর্নীতিবাজ ও অর্থ পাচারকারীর কারণে দেশের মাথা নিচু হতে দেওয়া যাবে না। তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। এজন্য দুদক সবার সম্মিলিত সহযোগিতা প্রত্যাশা করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক যুগান্তরকে বলেন, আমরা আমাদের কথা প্রতিবেদন আকারে রাষ্ট্রপতির কাছে তুলে ধরব। তিনি প্রতিবেদনটি জাতীয় সংসদে উত্থাপনের ব্যবস্থা করবেন। কমিশনার আরও জানান, প্রতিবেদনটি নতুন রাষ্ট্রপতির কাছেও দাখিল করা হবে।