উত্তরবঙ্গ থেকে গরু-মহিষবাহী ট্রাক টানেল হয়ে অল্প সময়ে ঢুকে যাচ্ছে আনোয়ারার সরকার হাটে। সাশ্রয় হচ্ছে জ্বালানি খরচ, কমেছে চাঁদাবাজি। যে হাটে প্রতি সপ্তাহে বেচাকেনা হচ্ছে ৭ কোটি টাকার পশু। টানেলের শহর প্রান্তের পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা প্রান্তের পুরো ৭ কিলোমিটার এলাকা পরিণত হয়েছে বিশাল পর্যটন স্পটে। যেখানে রেস্টুরেন্ট ও খাবারের দোকানে দৈনিক বেচাকেনা ৫০ লাখ টাকার বেশি কিংবা আনোয়ারা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে মাত্র ১ মাসে ১৫ কোটি টাকার জমি বেচাকেনার দলিল। এসবে বোঝা যায়, টানেল কতটা বদলে দিয়েছে এখানকার জীবনচিত্র।
কর্ণফুলী নদীকে যুক্ত করে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ স্বপ্ন থেকে গত ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। চালুর পর মাত্র ১৫ দিনে বদলে গেছে এলাকার চিত্র। ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে আগে কম করে হলেও ৯ ঘণ্টা সময় লাগত। এখন চট্টগ্রাম শহর থেকে টানেল হয়ে আনোয়ারা কালাবিবির দীঘি পর্যন্ত মাত্র সাত কিলোমিটারে চার লেনের সড়ক কমিয়ে দিয়ে ঢাকা কক্সবাজারের ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব। ফৌজদারহাট বাইপাস হয়ে টানেলে ঢুকে মাত্র ৭ ঘণ্টায় পৌঁছা যাচ্ছে দেশের প্রান্তসীমায়। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে মালপত্র পরিবহন এখনে অনেক বেশি সহজ। পূর্বমুখী দিগন্ত উন্মোচনে এশিয়ান সড়ক নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থেকে আনোয়ারা প্রান্তে গড়ে উঠেছে শতাধিক নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। চালু হওয়ার অপেক্ষায় অন্তত ৩টি শিল্প কারখানা। কারাবিবিরদীঘি এলাকা হয়ে উঠেছে নতুন বাণিজ্যিকপাড়া। বেঙ্গল ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী, যমুনা ব্যাংক, আইএফআইসি, কমার্স ব্যাংক ইতোমধ্যে তাদের শাখা খুলেছে। চালুর অপেক্ষায় আছে এনসিসি ব্যাংক ও ট্রাস্ট ব্যাংকের দুটি শাখা। বেসরকারি এনসিসি ব্যাংক লিমিটেডের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান এস এম আবু মহসীন বলেন, টানেলকেন্দ্রিক ব্যবসায়িক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে আনোয়ারায় ব্যাংকের নতুন নতুন শাখা হচ্ছে। আগামী দিনে কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরের এ এলাকাটি হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন প্রাণকেন্দ্র। এটি কক্সবাজার পর্যন্ত বিশাল অর্থনৈতিক করিডোরের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
টানেল চালুর পর দুই সপ্তাহের পর্যবেক্ষণের আলোকে শিক্ষাবিদ ও গবেষক প্রদীপ চক্রবর্তী বলেন, টানেলকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক টার্নওভার ১৫ দিনে শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এখানকার ব্যাংকের ৫ শাখায় ১৫ দিনে গ্রাহকের লেনদেন হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। জমি বেচাকেনা হয়েছে ১৫ কোটি টাকা, হোটেল-রেস্টুরেন্টে বিক্রি ৮ কোটি, টোল আদায় ২ কোটি, সরকার হাটে গরুর বাজারে বিক্রি ১৫ কোটি, শাক-সবজি, পরিবহন, দোকানের সওদাপাতি থেকে যোগ হয়েছে আরও প্রায় ৩০ কোটি টাকা। যত দিন যাবে, তা আর বাড়বে।
টানেল ঘিরে বৃহত্তর অর্থনৈতিক জোন গড়তে আসছে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার চার লেনের জাতীয় মহাসড়ক করার পরিকল্পনা। গত ৩১ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী পরিষদের (একনেক) বৈঠকে প্রকল্পটি অনুমোদন পেয়েছে। এ প্রকল্পে পটিয়া, দোহাজারী, লোহাগাড়া ও চকরিয়ায় বাইপাস এবং কেরানিহাটে ফ্লাইওভারসহ পাঁচ পয়েন্টে ২৬ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীত হবে। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষে আর মাত্র ২ মাস পর ১ জানুয়ারি থেকে কাজ শুরুর কথা রয়েছে।
কর্ণফুলীর দুপাড়ে শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। গড়ে উঠছে শিল্প-কারখানা। বাস্তবায়ন হচ্ছে মেগা সব প্রকল্প। পর্যটনও দেখাচ্ছে অপার সম্ভাবনা। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, পারকি সৈকত এমনকি টানেলের দুই প্রান্তে এখন বিকেলের পর থেকে মানুষের ঢল। যেসব জমি একসময় কেউ নিতে চাইতেন না, এখন তারও দাম ৫ থেকে ১০ গুণ বেড়েছে। আনোয়ারা প্রান্তের কালাবিবির দীঘি থেকে তৈলারদ্বীপ, পারকি, বরকল পর্যন্ত এলাকাগুলোর ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক চিত্রই পাল্টে যাচ্ছে। আনোয়ারা উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার রেজাউল করিম বলেন, এক মাসে ৪৮৭টি দলিল রেজিস্ট্রি হয়েছে। সরকার রাজস্ব পেয়েছে ২৫ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এসব দলিলের অফিসিয়াল মূল্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা। কাগজে-কলমের এই মূল্যের তুলনায় বাস্তবে বিক্রীত জমির দাম দ্বিগুণ হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
টানেলকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের ধাক্কা আঁচ করা গিয়েছিল শুরু থেকে। বেড়াতে আসা লোকজনের পারাপারে আনোয়ারা প্রান্তের কালাবিবির দীঘি মোড়ে বসে গেছে অঘোষিত বাস স্টপেজ। এখানকার ২০টি বাস রাউন্ড ট্রিপে টানেলের ভেতর দিয়ে প্রায় ৮ হাজার মানুষকে পারাপার করছে। ভাড়া আদায় হচ্ছে প্রায় ৪ লাখ টাকা। মাইক্রোবাস ও কার ভাড়া করেও পার হচ্ছে কয়েকশ’ মানুষ। পিএবি সড়ক বাস মালিক সমিতির সভাপতি জাফর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, দর্শনার্থীর চাপ সামলাতে আনোয়ারা সদর থেকে ইপিজেড পর্যন্ত বাস সার্ভিস চালুর জন্য ৩০টি বাসের পারমিট চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। শুধু বাসে বা বেড়ানোর ধুম নয়, টানেল চালুর পর এখানকার খাবারের দোকান ও রেস্টুরেন্টে বেচাবিক্রি চলছে রাত-দিন। আনোয়ারা প্রান্তের ৫ রেস্টুরেন্টে ১২ লাখ টাকা, পারকি সৈকতের ৪০ দোকানে প্রায় ৫ লাখ, পতেঙ্গা সৈকতের ২শ’ ভাসমান দোকানে ৩০ লাখ মিলিয়ে দৈনিক বিক্রির পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অবরোধ-হরতালসহ নানা কর্মসূচির মধ্যে টানেলে মাত্র ১৫ দিনে গাড়ি পারাপার ছুঁয়েছে ৮০ হাজারের ঘর। তাতে প্রায় ২ কোটি টাকার টোল আদায় হয়েছে বলে জানিয়েছেন টানেল টোল প্লাজার ব্যবস্থাপক বেলায়েত হোসেন।
ভূমিমন্ত্রী ও আনোয়ারা-কর্ণফুলী থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বলেন, টানেল এর মধ্যে পাল্টে দিয়েছে কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরের চিত্র। এর সুফল সুদূরপ্রসারী। আর কয়েক বছর গেলে আরও স্পষ্ট হবে, টানেল এই অঞ্চলের মানুষের জন্য কত বড় সম্পদ। কক্সবাজার পর্যন্ত বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।