২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৬:২৩:২১ অপরাহ্ন
প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে নির্বাচনে
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-০১-২০২৪
প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে নির্বাচনে

সিটি করপোরেশন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী মনোনয়ন বা দলীয় প্রতীক না দিলে এ নির্বাচন তুলনামূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে-এমন মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, মেয়র বা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী উন্মুক্ত রাখা হলে একই দলের অনেকেই প্রার্থী হতে উৎসাহী হবেন। বিএনপিসহ যেসব দল নির্বাচন বর্জন করছে, সেসব দলের অনেকেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। শুধু তাই নয়, দলনিরপেক্ষ স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিদেরও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগ্রহ তৈরি হবে।


বেশিসংখ্যক প্রার্থী অংশ নিলে নির্বাচন যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে, তেমনই ভোটার উপস্থিতিও বাড়বে। নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরিতে সুবিধা হবে। তবে নির্বাচনে সহিংসতা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রবণতা বাড়ার আশঙ্কাও করছেন। উদাহরণ হিসাবে তারা বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেসব আসনে বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে, সেখানে সহিংসতা ও আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের ঘটনা বেশি ছিল।


নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও মাঠ পর্যায়ের সাত কর্মকর্তা এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ করে পাওয়া গেছে এমন মন্তব্য। এসব কর্মকর্তা প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। নাম গোপন রাখার শর্তে তারা বলেন, বিদ্যমান আইনে রাজনৈতিক দলের মনোনীত বা স্বতন্ত্র দুভাবে প্রার্থী হওয়া যায়। আইন সংশোধন না করেও আসন্ন সিটি করপোরেশন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করা যাবে। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়ন না দিলে তাদের নেতাকর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে অংশ নিতে পারবেন। নিবন্ধিত অন্য রাজনৈতিক দল মনোনয়ন দিলে সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন বা আওয়ামী লীগের বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।


উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেওয়া হলেও আইনের ব্যত্যয় হবে না বলে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। এদিন সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি আরও বলেন, আইন সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই। দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা যাবে, দলীয় প্রতীক ছাড়াও নির্বাচন করা যাবে। এতে আইনের ব্যত্যয় হবে না।’ তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যদি মনে করে সেখানে দলীয়ভাবে মনোনয়ন দেবে, তাহলে সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আবার দল যদি মনে করে, না, আমরা এভাবে দলীয় মনোনয়ন কাউকে দেব না, আবার কোথাও কোথাও দেব, কোথাও কোথাও দেব না-দল থেকে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ আছে।’


স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া বা না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল যদি মনে করে তারা দলীয় প্রতীকে মনোনয়ন দেবে না, সেটা তাদের বিষয়। সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো মন্তব্য নেই। এ নিয়ে কোনো সমস্যাও নেই।


রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন নিয়ে এবং স্বতন্ত্র হিসাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া যায়। কোনো রাজনৈতিক দল দলীয় প্রতীক না দিলে সেক্ষেত্রে তারা (ওই দলের নেতাকর্মীরা) স্বতন্ত্রদের নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন করতে পারবেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হলে সংশ্লিষ্ট উপজেলার ২৫০ জন ভোটারের সমর্থন রয়েছে-এমন প্রমাণ জমা দিতে হবে। আর যদি কেউ এর আগে উপজেলা চেয়ারম্যান বা ভাইস চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়ে থাকেন, তাহলে তাদের ভোটারের সমর্থনযুক্ত তালিকা জমা দিতে হবে না। জাতীয় সংসদের তুলনায় উপজেলা পরিষদে ভোট আরও সুষ্ঠু ও সুন্দর হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।


আসন্ন রোজার ঈদের পর এবং ৩০ এপ্রিলের আগে প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। মে মাসের মধ্যে সারা দেশের নির্বাচনযোগ্য উপজেলায় ভোটগ্রহণ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। এছাড়া ৯ মার্চ কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন এবং একই দিন ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে সাধারণ নির্বাচনে ভোট হবে। সোমবার আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের জরুরি সভায় সিটি করপোরেশন ও উপজেলা পরিষদে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখছে দলটি।


নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দেওয়া না হলে প্রার্থী এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের আইন অনুমোদন করে সরকার। ওই সিদ্ধান্তের ফলে নির্বাচনে প্রার্থী সংখ্যা কমে যায়। সমাজের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যারা সরাসরি দল করেন না, তারা নির্বাচনে অংশ নিতে নিরুৎসাহিত হয়ে আসছেন। প্রশাসনও সরকারি দলের বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারত না। নির্বাচনে এমন সংস্কারের ফলে প্রার্থীর মানে অবনতি হয়েছে। তিনি বলেন, এখন আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেলে নির্বাচনে প্রার্থী বাড়বে। দলীয় নির্বাচন না হওয়ায় বিএনপির নেতাকর্মীদের অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। যদিও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির দৃশ্যপটই পরিবর্তন হয়ে গেছে। মানুষ ভোটের ওপরই আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন।


প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ১২ অক্টোবর স্থানীয় সরকারের পাঁচটি স্তরেই (সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ) দলীয় পরিচয় ও প্রতীকে নির্বাচন করতে আইনের সংশোধন অনুমোদন করে তৎকালীন মন্ত্রিসভা। বিরোধী দলগুলোর বিরোধিতার মুখে জাতীয় সংসদে প্রতিটি নির্বাচনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আইন সংশোধন হয়। ওই আইনে শুধু নিবন্ধিত দলগুলোকে প্রার্থী দেওয়ার বিধান রাখা হয়। এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হলে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানভেদে ভিন্নসংখ্যক ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষর জমা দেওয়ার বিধান করা হয়। ওই আইন এখনো বলবৎ রয়েছে। ফলে আসন্ন সিটি করপোরেশন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলের নেতাকর্মীদের মনোনয়ন না দিলে দলটির নেতাকর্মীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির তিনজন আঞ্চলিক এবং দুজন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা প্রায় অভিন্ন মন্তব্য করে যুগান্তরকে বলেন, দলীয় প্রার্থী না দিলে একই দলের একাধিক নেতাকর্মী নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। তখন প্রশাসনের ওপর সরকারি দলের প্রার্থীর প্রভাব ও চাপ কমে যাবে। নির্বাচনের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ করা এবং ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতে সুবিধা হবে। সবচেয়ে বেশি সুবিধা হবে ভোটকেন্দ্রের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। কারণ হিসাবে তারা বলেন, তখন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা পোলিং এজেন্ট দেবেন। ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোটের ঘটনা ঘটলে পোলিং এজেন্টরাই প্রতিবাদ করবেন। পাশাপাশি প্রার্থীরা জয়ী হতে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসবেন। এর ফলে নির্বাচনে ভোটারবিমুখতার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা কিছুটা হলেও কমবে। তবে তারা সব দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।


একই সঙ্গে এসব কর্মকর্তা কিছু শঙ্কার কথাও জানান। তারা বলেন, প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেওয়ায় দলীয় গ্রুপিং অনেক বেড়ে যাবে। নির্বাচনে সহিংসতাও বাড়বে। মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে। নির্বাচনের সুযোগে অন্যান্য অপরাধও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।


শেয়ার করুন