আইনপ্রণেতা হিসেবে দেশের রাজনীতিতে আইনজীবীদের এক সময় দাপট ছিল। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনজীবীদের অংশগ্রহণ কমেছে। বেড়েছে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ। আগামী পাঁচ বছর যারা জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নে ভূমিকা পালন করবেন, তাদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই ব্যবসায়ী। নির্বাচিত ২৯৮ জন বিজয়ী সংসদ সদস্যের মধ্যে অন্তত ১৯৯ জন ব্যবসায়ী। রাজনীতিবিদ রয়েছেন ২৭ জন। এর পরই আইনজীবী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ২৪ জন। এ ছাড়া কৃষি খাতে আয় করেন এমন সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন ১৪ জন, চিকিৎসক ১২ জন, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ৬ জন এবং শিক্ষক আছেন ৫ জন। সদ্য নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখন ব্যবসা আর রাজনীতি একাকার হয়ে গেছে। যেটা ব্যবসা, সেটাই রাজনীতি। তারা (সংসদ সদস্য) জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদের অবস্থানকে ব্যাবসায়িক সুবিধা অর্জনের ক্ষেত্র হিসেবে দেখেন। এতে করে সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার কোনো প্রতিফলন হয় না। এতে করে যারা মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, তাদের ব্যাবসায়িক প্রতিপত্তি না থাকায় দিন দিন কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল ১৮২ জন, ৬১ শতাংশ। বাকিদের মধ্যে আইনজীবী ১৪ শতাংশ, রাজনীতিবিদ ছিলেন ৭ শতাংশ। কৃষিজীবী ৪ শতাংশ এবং ১৪ শতাংশ অন্যান্য পেশার ছিলেন। আর প্রথম জাতীয় সংসদে মাত্র ১৮ শতাংশ ছিলেন ব্যবসায়ী। রেকর্ড ভেঙে দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে অন্তত ১৯৯ জন। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হয়ে জয়ী হয়েছেন।
জানা গেছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৯৮ আসনে বিজয়ীদের মধ্যে ব্যবসায়ী ১৯৯ জন। তার মধ্যে আওয়ামী লীগের ১৪৯ জন, জাতীয় পার্টির ৯ জন, জাসদের ১ জন, কল্যাণ পার্টির ১ জন এবং স্বতন্ত্র ৩৯ জন রয়েছেন।
হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ব্যবসায়ীর মধ্যে আছেনÑ বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান, সেপাল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা টিপু মুনশি, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আ হ ম মুস্তফা কামাল, রেনেসাঁ ও ইন্টারস্টফ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও উদ্যোক্তা মো. শাহরিয়ার আলম, বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান মোরশেদ আলম, হা-মীম গ্রুপের কর্ণধার একে আজাদ, এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুস সালাম মুর্শেদী প্রমুখ। এ ছাড়া গোলাম দস্তগীর গাজী, কাজী নাবিল আহমেদ, সাঈদ খোকন, ওয়াকিল উদ্দিন, তাজুল ইসলাম, সেলিম ওসমান, সাধন চন্দ্র মজুমদার উল্লেখযোগ্য।
পেশায় রাজনীতিবিদদের মধ্যে আছেন- রাশেদ খান মেনন, জিএম কাদের, মতিয়া চৌধুরী, আ স ম ফিরোজ, তোফায়েল আহমেদ, উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস সহিদ, নুরুল ইসলাম নাহিদ, ময়েজ উদ্দিন শরীফ প্রমুখ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হলফনামায় নিজেকে বেসরকারি চাকরিজীবী উল্লেখ করেছেন।
পেশায় আইনজীবী আছেন- আনিসুল হক, শ ম রেজাউল করিম, বীরেন শিকদার, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল প্রমুখ। হলফনামায় সমাজসেবক হিসেবে পেশা উল্লেখ করেছেন প্রয়াত মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেনগুপ্ত। আব্দুল লতিফ পেশা উল্লেখ করেছেন গবেষক ও লেখক। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে আছেন আবুল কালাম আজাদ, সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ড. মোহাম্মদ সাদিক প্রমুখ। পেশায় সম্মানী ভাতা লিখেছেন আ ক ম বাহাউদ্দীন বাহার।
পেশায় চিকিৎসক নির্বাচিত হয়েছেন- শিশুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল আজিজ, নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত, অর্থোপেডিক অধ্যাপক আ ফ ম রুহুল হক, ডা. হামিদুল হক খন্দকার প্রমুখ। ক্রিকেটার হিসেবে নতুন করে যুক্ত হয়েছেন সাকিব আল হাসান। জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা হলফনামায় নিজের পেশা উল্লেখ করেছেন রাজনীতিবিদ।
প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জানায়, নির্বাচনে ১ হাজার ৯৪৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ১ হাজার ১৪২ জনই ছিলেন ব্যবসায়ী (৫৮ দশমিক ৭১ শতাংশ)। আওয়ামী লীগের ২৬৫ জনের মধ্যে ১৭০ জন, জাতীয় পার্টির ২৬২ জনের মধ্যে ১৭৩ জন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৩৩ জনের মধ্যে ৩০২ জনই ব্যবসায়ী।