২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ০১:১০:৩০ পূর্বাহ্ন
শেয়ারবাজারে করের কোপ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৬-২০২৪
শেয়ারবাজারে করের কোপ

দুর্বল অস্তিত্বে টিকে আছে দেশের সম্ভাবনার শেয়ারবাজার। টানা পতনে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে। বছরের বেশির ভাগ সময়ই লেনদেনে খরা। এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের ভরসা ছিল বাজেট। সরকার বিনিয়োগকারীদের কথা মাথায় রাখবে। কিন্তু ফল উলটো। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে গিয়ে সরকারের কাছে অনেক আগেই শেয়ারবাজারের গুরুত্ব হারিয়েছে। প্রণোদনার পরিবর্তে নতুন কর আরোপ করা হয়েছে। নতুন করে মূলধনি মুনাফায় কর আরোপের মাধ্যমে আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এটি যেন ‘মরা শেয়ারবাজারে খাঁড়ার ঘা’।

করপোরেট করে এমন গোঁজামিল দেওয়া হয়েছে, যা শেয়ারবাজারের জন্য অশনিসংকেত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজেটে মূলত তিন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সরাসরি বরাদ্দ, কর কমানো কিংবা বাড়ানো এবং সংস্কারের বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু টানা কয়েক বছরের মতো এবারও বাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়াবে-এমন কোনো পদক্ষেপ আসেনি। উলটো কর বাড়ানো হয়েছে।

শেয়ারবাজারে মূলধনি মুনাফার ওপর কর বসানো হয়েছে। এক্ষেত্রে যেসব বিনিয়োগকারী বছরে শেয়ারবাজার থেকে ৫০ লাখ টাকার বেশি মুনাফা করেন, তাদেরকে অতিরিক্ত মুনাফার জন্য ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। অর্থাৎ কোনো বিনিয়োগকারী সেকেন্ডারি মার্কেটে শেয়ার বেচাকেনা করে ৫১ লাখ টাকা আয় করলে তাকে ১৫ হাজার টাকা কর দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে এই হারে কর বাড়তে থাকবে। সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে পতনের এটা বড় কারণ। কেননা অনেক বড় বিনিয়োগকারী বাজার থেকে বেশি মুনাফা করে। এর মধ্যে অনেকে নিজের নামে নয়, বেনামে শেয়ার কেনাবেচা করে। তাই তাদের কর দিতে হয় না। কিন্তু নতুন করে কর আরোপ করা হলে পর্দার আড়ালে থাকা রাঘববোয়ালরা চিহ্নিত হয়ে যাবে। তবে এতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ওপর খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। সিডিবিএল সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে সক্রিয় বিও অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ১৩ লাখ ২২ হাজার ৮৮৬টি। আর কোটিপতির সংখ্যা ১৪ হাজার। অর্থাৎ বর্তমানে মোট সক্রিয় বিনিয়োগকারীর ১ শতাংশ কোটিপতি। এর মধ্যে ১ হাজার কোটি টাকার ওপরে বিও অ্যাকাউন্ট ৪১টি, ১০০ কোটি থেকে ১ হাজার কোটির মধ্যে ৩৩০টি, ১০ কোটি থেকে ১০০ কোটি টাকার মধ্যে ২ হাজার ৬৫১টি, ১ থেকে ১০ কোটি টাকার মধ্যে ১০ হাজার ৯৯৩টি এবং ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার মধ্যে বিও অ্যাকাউন্ট সংখ্যা ৯৮ হাজার ১১০টি। এসব কোটিপতির অধিকাংশ তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালক। তারা বিভিন্ন সময়ে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে টাকা নেয়। তারাই কেবল ৫০ লাখ টাকার ওপরে মুনাফা করে। ফলে মূলধনি মুনাফার ওপর কর আরোপ করা হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ওপর তার প্রভাব পড়ার কথা নয়। তবে আতঙ্ক অন্য জায়গায়। মূলধনি মুনাফার ওপর কর আরোপের মাধ্যমে বিও অ্যাকাউন্টে টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

অন্যদিকে বর্তমানে কমপক্ষে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার ছেড়েছে, এমন কোম্পানিগুলোর আয়করের হার ২০ শতাংশ। তবে এর জন্য পরিপালন করতে হয় কিছু শর্ত। এগুলো হচ্ছে-কোম্পানির সব ধরনের আয় ও প্রাপ্তি, ব্যয় এবং বিনিয়োগ আনুষ্ঠানিক মাধ্যম তথা ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেন। আয়কর আইন অনুযায়ী যেসব কোম্পানি ৫ লাখ টাকার বেশি লেনদেনসহ ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করবে, তাদের ক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরের করহার প্রযোজ্য হবে। কিন্তু বর্তমানে দেশে এ ধরনের কোম্পানি সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। এ শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হলে কর দিতে হয় ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার আড়াই শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। যেসব কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার হস্তান্তর করেছে, তা আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ২২ শতাংশ করা হয়েছে। তবে শর্ত পালন করলে তা ২০ শতাংশ। অন্যদিকে ১০ শতাংশের কম শেয়ার ছেড়েছে-এমন কোম্পানির আয়করের হার ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ। শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হলে কর দিতে হয় ২৫ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে ১০ শতাংশের কম শেয়ার ছেড়েছে-এমন কোম্পানিগুলোর আয়করের হার ২৫ শতাংশ। তবে শর্ত পরিপালন করলে তা সাড়ে ২২ শতাংশ। এক্ষেত্রে ভাষাগত পরিবর্তন ছাড়া সবকিছুই আগের মতো। উলটো অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর কমানো হয়েছে। এছাড়াও শেয়ার তালিকাভুক্তির বাইরে থাকা কোম্পানিগুলোর বর্তমান কর সাড়ে ২৭ শতাংশ। শর্তপালনে ব্যর্থ হলে তা ৩০ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর সাড়ে ২৭ শতাংশ। কিন্তু পালন করলে তা ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর মানে হলো, তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করহার প্রায় সমান। এতে নতুন কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তিতে উৎসাহিত হবে না। কোম্পানির উদ্যোক্তাদের শেয়ার হস্তান্তরের ক্ষেত্রে কর বাড়ানো হয়েছে। আগে কোনো কোম্পানির উদ্যোক্তা কাউকে শেয়ার দিতে চাইলে ৫ শতাংশ কর দিতে হতো। প্রস্তাবিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। তবে কেউ ছেলেমেয়েসহ পরিবারের সদস্যদের শেয়ার দিতে চাইলে কর দিতে হবে না। এদিকে শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্টরাও প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে নারাজ। অন্যদিকে সমবায় সমিতির কর ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে।

শেয়ার করুন