আগ্রাসী ব্যাংকিংয়ের কারণে চতুর্থ প্রজন্মের ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের বোঝা ধীরে ধীরে বাড়ছে, যা এ মুহূর্তে ৭ হাজার কোটি টাকা ছুঁইছুঁই। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে একটি নতুন ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম।
বিশেষ প্রক্রিয়ায় বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। রুগ্ণ ব্যাংক হিসাবে ১০টি দুর্বল ব্যাংকের অন্যতম এটি। সম্প্রতি আর্থিক উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একটি বিশেষ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে ব্যাংকটি। এছাড়া অন্যান্য নতুন ব্যাংকের অবস্থাও সন্তোষজনক নয়। আস্থাহীনতায় ভুগছে। ভালো বিনিয়োগ না পাওয়ায় উল্লেখযোগ্য মুনাফার দেখাও মিলছে না।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক নির্দেশনার পরও শৃঙ্খলার মধ্যে আসেনি এসব ব্যাংক। কয়েকটি ব্যাংকের ঘাড়ে জেঁকে বসেছে পরিবারতন্ত্র। হচ্ছে নানা অনিয়ম-দুর্নীতিও। ফলে নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে এসব ব্যাংকে জমা রাখা আমানত। আর এ রোগ সংক্রমণে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে পুরো আর্থিক খাত।
রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণেই নিয়ম মানার কোনো তোয়াক্কা করছে না। এসব সমস্যা সমাধানে ব্যাংক নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। তবে পাঁচ বছর আগে ২০১৭ সালে এসব ব্যাংকের খেলাপি ছিল ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। সে হিসাবে পাঁচ বছরের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে পাঁচ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা।
এ সময়ে খেলাপি বেড়েছে ৮৩ শতাংশ, যা খুবই অস্বাভাবিক। বিপরীতে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ঋণ বিতরণ। অর্থাৎ চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকে ঋণ বিতরণের তুলনায় খেলাপির হার অনেক বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ৬৮ শতাংশ। কারণ গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির ঋণ বিতরণের অঙ্ক ছিল ৫ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। কিন্তু পাঁচ বছর আগেও ব্যাংকটির ঋণ বিতরণের অঙ্কে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। কারণ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা বা সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের ঋণের অঙ্ক ছিল ৫ হাজার ১৩০ কোটি। এর মধ্যে খেলাপি ছিল মাত্র ৭২৩ কোটি টাকা। সেসময় খেলাপি ঋণের হার ছিল মাত্র ১৪ শতাংশ।
পরবর্তী সময়ে ঋণ না বাড়লেও বেড়েছে শুধু খেলাপি। কারণ ফারমার্স ব্যাংক নাম থাকা অবস্থায় ব্যাংকটিতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। তারই ফল এটি। প্রসঙ্গত, ফারমার্স ব্যাংক থেকে নাম পরিবর্তন করে পদ্মা হওয়া ব্যাংকটির যাত্রা ২০১২ সালে। কিন্তু সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতিতে পাঁচ বছরের মধ্যেই বিপর্যয়ের শিকার হয় ব্যাংকটি। ধারাবাহিকভাবে গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালে ফারমার্স ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুনর্গঠন করা হয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ, অপসারণ করা হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালককে।
এরপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে পদ্মা ব্যাংক রাখা হয়। তবে বড় পরিবর্তনের প্রায় পাঁচ বছরেও ব্যাংকটির উন্নতি দৃশ্যমান হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে পদ্মা ব্যাংকের ৬৮ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা নিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। বিনিময়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে জোগান দিতে হয়েছে ৭১৫ কোটি টাকার পুঁজি। ২০১৮ সালে দেওয়া এসব পুঁজির বিপরীতে এখনো কোনো মুনাফা পায়নি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত যুগান্তরকে বলেন, নতুন গভর্নর বিভিন্ন ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করছেন। এরই ধারাবাহিকতায় পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে বসেছেন। তিনি বলেন, এটা একটা সৌজন্য সাক্ষাৎ।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসাবে যে কোনো ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করতে পারে। আর আগে কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে। সেই ধারাবাহিতকায় পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক করেছে। ব্যাংকটিকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি অন্য সূচকগুলোও স্থিতিশীল রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ইউনিয়ন ব্যাংকের বর্তমান খেলাপির অঙ্ক ৭১২ কোটি, যা মোট ঋণের প্রায় চার শতাংশ। তবে পাঁচ বছর আগে ব্যাংকের খেলাপির হার ছিল শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে মেঘনা ব্যাংকের ঋণ বিতরণের অঙ্ক ছিল ২ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে খেলাপির অঙ্ক ছিল মাত্র ৯৩ কোটি, যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ।
হালাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মেঘনা ব্যাংকের খেলাপি দাঁড়িয়েছে ২৪১ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের প্রায় ৬ শতাংশ। এ বছরের জুন শেষে চার হাজার ৭৯০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে মিডল্যান্ড ব্যাংক। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ১৬২ কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী খেলাপি ঋণ বিতরণকৃত মোট ঋণের প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ। বর্তমানে মধুমতি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার তিন দশমিক ৪৩ শতাংশ। কারণ চলতি বছরের জুন শেষে পাঁচ হাজার ২৫৪ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে মধুমতি ব্যাংক।
এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ১৮০ কোটি টাকা। যদিও পাঁচ বছর আগে ব্যাংকের খেলাপির হার ছিল একেবারেই নগণ্য। কারণ ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণ ছিল দুই হাজার ৭৯০ কোটি। যেখানে খেলাপি ছিল মাত্র ৯ কোটি টাকা। বর্তমানে সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার ব্যাংকের ঋণ বিতরণের অঙ্ক সাত হাজার ৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৪১৮ কোটি, যা বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ছয় শতাংশ।
পাঁচ বছর আগে ব্যাংকের ঋণ ছিল চার হাজার ৩০৬ কোটি। যার মধ্যে খেলাপি ছিল মাত্র ৩১ কোটি টাকা। বর্তমানে এনআরবি ব্যাংকের মোট খেলাপির অঙ্ক ২১৫ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের চার দশমিক ৫২ শতাংশ। এই ব্যাংকের খেলাপি বিপৎসীমার নিচেই রয়েছে। একইভাবে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৩৩০ কোটি বা ৩ দশমিক ০৩ শতাংশ এবং এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার পাঁচ শতাংশের কাছাকাছি। অঙ্কে যা ৬০০ কোটি টাকা।
জানা গেছে, অনুমোদন পাওয়ার পূর্বশর্ত ছিল কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে গুরুত্ব দেওয়া এবং সেবায় নতুনত্ব আনা। পাশাপাশি অনুমোদনের তিন বছরের মাথায় দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এসব শর্তের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকগুলো।
তথ্যমতে, ব্যাংক অনুমোদনের প্রথম তিন বছরের মধ্যেই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা ছিল এই নয় ব্যাংকের। কিন্তু ১০ বছর অতিক্রম করলেও এখন পর্যন্ত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পেরেছে মাত্র তিনটি-সাউথ বাংলা অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার, এনআরবি কমার্শিয়াল ও ইউনিয়ন ব্যাংক। বাকিরা এখনো তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। এছাড়া নতুন ব্যাংকগুলো কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণেও পিছিয়ে পড়েছে।
এদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পদ্মা ব্যাংকের। ব্যাংক অনুমোদনের সময় কৃষি ও পল্লি ঋণ বিতরণ প্রধান শর্ত থাকলেও গত অর্থবছরে ব্যাংকটি কোনো ঋণ বিতরণ করেনি। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেও ব্যাংকটির কৃষি ও পল্লি ঋণের কোনো তথ্য নেই। তাছাড়া পদ্মা ব্যাংকের ওয়েবসাইটেও কৃষি ঋণসংক্রান্ত কোনো পণ্যের বিবরণ নেই। সুতরাং কৃষিঋণ বিতরণে অনাগ্রহী। এছাড়া গত অর্থবছরে ইউনিয়ন ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রার ১৯ শতাংশ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে।