২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ০৫:৫৩:১৩ অপরাহ্ন
মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে আধিপত্য বিস্তার করছে চীন
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৪-২০২৩
মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে আধিপত্য বিস্তার করছে চীন

চীনের মধ্যস্থতায় দেশটির রাজধানী বেইজিংয়ে গত ১০ মার্চ স্বাক্ষরিত এক চুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘ সাত বছরের বৈরিতার অবসান ঘটায় মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রভাবশালী দেশ ইরান ও সৌদি আরব। এবার সেই বেইজিংয়েই বৈঠক করেছেন দুই মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।

এর আগে গত ১০ মার্চ বেইজিংয়ে বৈঠকে বসেন রিয়াদ ও তেহরানের কূটনীতিকরা। এতে মধ্যস্থতা করেন চীনের এক শীর্ষ কূটনীতিক। এর পর দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চীন ওই চুক্তি স্বাক্ষরের ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছে।

২০১৬ সালে সৌদি আরবে এক শিয়া আলেমের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর এবং এর প্রতিবাদে তেহরানে অবস্থিত সৌদি দূতাবাসে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলা কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থগিত হয়ে যায়।

মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের ভূমিকা বেশ জোরালোভাবে দেখা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে ওয়াশিংটনের জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা। মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা প্রশমন এবং ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে চীনের মধ্যস্থতায় গত মার্চে প্রতিন্দ্বন্দ্বী দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়। 

মধ্যপ্রাচ্যের সাথে চীনের সম্পর্ক বাণিজ্য, অর্থনীতি ও বিনিয়োগকে ঘিরে। তবে গত কয়েক বছরে চীন তার রাজনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণে কূটনৈতিক এজেন্ডাকেও শক্তিশালী করতে ক্রমবর্ধমান আগ্রহ প্রকাশ করছে। 

২০২২ সালের ডিসেম্বরে শি জিনপিং যখন রিয়াদ সফর করেন, তখন তাকে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে মধ্যস্থতা করতে এবং আলোচনাকে ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনতে বলা হয়েছিল। এটিকে গ্লোবাল সাউথের একটি সহজ জয় হিসাবে গ্রহণ করে, চীন মধ্যস্থতা করতে সম্মত হয়েছে এবং আমরা কয়েক মাস পর তাদের শ্রমের ফল দেখতে পাচ্ছি।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও রাশিয়া বিশ্বে নতুন মেরুকরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ তাদের বৈশ্বিক অংশীদারদের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনার চিন্তাভাবনা করছে। কিন্তু সৌদি আরবের মতো দেশ যখন চীনের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, তখন বিষয়টি গুরুত্বের দাবি রাখে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করার মতো অবস্থায় এখনো না গেলেও চীন ধীরে ধীরে সেই পথে হাঁটছে কি না—এই প্রশ্নও উঠছে।

বছরের পর বছর ধরে চীন মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র সরবরাহকারী হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে এবং এই অঞ্চলে একটি উল্লেখযোগ্য কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি যে দ্রুত কমছে ইরান-সৌদি মীমাংসা চুক্তিকে তার জলজ্যান্ত একটি উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।

এমন কথাও অনেক বিশ্লেষক বলছেন, সৌদিরা আট দশক পর শেষ পর্যন্ত আমেরিকার একচ্ছত্র প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথ নিয়েছে।

চীন মধ্যপ্রাচ্যকে তিনটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসাবে বিবেচনা করে। প্রথমত, চীনের জ্বালানি আমদানির ৪০ শতাংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। দ্বিতীয়ত, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ সৌদি আরব ও ইরানের মধ্য দিয়ে যাবে। এ ছাড়া এসব শান্তি আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বমঞ্চে নিজেকে শক্তিশালী  হিসাবে নিজেকে প্রদর্শন করতে পারবে দেশটি।

বিশ্ব রাজনীতিতে চীন আরও সক্রিয় অবস্থান গ্রহণের বৈশ্বিক উপলব্ধি একটি অতিরঞ্জিত কিছু হতে পারে। স্পর্শকাতর বিষয়ে কোনো পক্ষ না নিয়ে চীন সব পক্ষের সঙ্গে বাণিজ্য সহযোগিতা বাড়ানোর সুবিধা নিতে পেরে ভালো অবস্থানে রয়েছে। 

সংবেদনশীল ইস্যুগুলোর অবসান ঘটাতে এবং বিশ্বশক্তিগুলোকে দ্বন্দ্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর অজুহাত দেওয়ার শিল্পে চীন দীর্ঘদিন ধরে পারদর্শী।

এরই মধ্যে, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি সবার জন্য মঙ্গলজনক বলে বেইজিংয়ের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। একই সময়ে, তেহরান রিয়াদকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে কিনা তা নিয়ে তারা সন্দিহান।

২০১৯ সালে তাদের সবচেয়ে বড় তেলের স্থাপনায় ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সৌদিদের প্রচণ্ড ভীত করে তুলেছিল।

সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে সমঝোতা চুক্তি কতদিন টিকবে তা নিয়ে এখনও বহু বিশ্লেষক সন্দিহান। কারণ এই দুই বৈরি দেশের রেষারেষির পেছনের মৌলিক কারণগুলো সহসা দূর হওয়ার সম্ভাবনা কম।

কিন্তু তারপরও সন্দেহ নেই, মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে এটি একটি মোড়-ঘোরানো পর্ব। কারণ, বহুদিন পর ওই অঞ্চলের এত বড় একটি ঘটনায় আমেরিকা অনুপস্থিত, আর মঞ্চের কেন্দ্রে চীন।

ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে পরবর্তী কূটনৈতিক পদক্ষেপ কী হবে তা দেখার জন্য এখন শুধু অপেক্ষা করা যেতে পারে। 
সৌদি আরব চীনকে তেহরানের ওপর চাপ দিতে কতটা রাজি করতে পারবে তা স্পষ্ট নয়, কারণ মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে চীনের আসল পরীক্ষা এখনও আসেনি। 

শেয়ার করুন