২৪ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ০১:১০:২২ অপরাহ্ন
বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের ফসল রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-১২-২০২৩
বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের ফসল রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসাবে সারাবিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। একের পর এক মেগা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, যোগাযোগ, ব্যবসাবাণিজ্য ও নাগরিক সুবিধার ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমান সরকারের ১০টি বৃহৎ প্রকল্পের সুফল নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক প্রতিবেদন-


দেব দুলাল মিত্র : বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) প্রকল্পটি বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। বিদ্যুৎ খাতে দুদেশের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতার অংশ হিসেবে এ প্রকল্পের আওতায় রামপাল মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। এরই মধ্যে দুই ইউনিট বিশিষ্ট এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে- যার সুফল বাংলাদেশের জনগণ পেতে শুরু করেছে। প্রতিটি ইউনিট ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের একটি অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রামপাল তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে পরিচিতি পেলেও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এবং ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) যৌথ কোম্পানি গঠন করে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। তাই প্রকল্পটির নাম বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বিনিয়োগে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত। দুই দেশের দুই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এই কোম্পানির সমান অংশীদার। অনেকের কাছে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প নামেও পরিচিত। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি


নির্মাণের লক্ষ্যে ২০১০ সালে ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং ভারতের এনটিপিসি লিমিটেডের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)’ নামে কোম্পানি গঠন করা হয়। দুই ইউনিট বিশিষ্ট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে ভারতীয় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ‘ভারত হেভি ইলেকট্রিক লিমিটেড (বিএইচইএল)। প্রতিটি ইউনিট থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট হিসাবে দুই ইউনিট থেকে উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার রাজনগর ও গৌরম্ভা ইউনিয়নের সাপমারী কৈগর্দ্দাশকাঠি মৌজায় ১ হাজার ৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয় ১৭ হাজার ৭৭৮ কোটি ৫৬ লাখ টাকা টাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপরই শুরু হয় জমি ভরাট ও সড়ক নির্মাণের কাজ।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে প্রায় ৯ বছর সময় লেগেছে। ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে পরীক্ষামূলক সরবরাহ (ট্রান্সমিশন) শুরু হয়। একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় গ্রিডে বাণিজ্যিকভাবে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হয়। দিল্লি সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। চলতি বছরের ২৮ জুন সকাল ৮টা ৫১ মিনিটে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে ৬৬০ মেগাওয়াটের মধ্যে ১৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সফলভাবে যুক্ত হয়। এরপর গত আগস্ট মাস থেকে এই ইউনিটের ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিয়মিত জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ হচ্ছে।

বিপিডিবির কর্মকর্তারা জানান, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছাকাছি সুন্দরবনের অবস্থান হওয়ায় পরিবেশগত প্রভাব কার্যকরভাবে প্রশমিত করতে সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। ফ্লু গ্যাস নির্গমনের বিস্তৃত বিচ্ছুরণের জন্য এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে লম্বা চিমনি দেয়া হয়েছে। এই চিমনির দৈর্ঘ্য ২৭৫ মিটার।

ইন্দোনেশিয়া থেকে নিয়ে আসা কয়লায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে এই কেন্দ্রে। প্রয়োজনে অস্ট্রেলিয়া থেকেও কয়লা আনার পরিকল্পনা রয়েছে। আমদানিকৃত কয়লা খালাসের জন্য একটি অগ্রিম জাহাজ আন-লোডার নির্মাণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি একটি সম্পূর্ণ আচ্ছাদিত কয়লা স্টক ইয়ার্ড, কম ছাই ও সালফার সামগ্রীসহ উচ্চ গ্রেডের আমদানি করা কয়লা ব্যবহারসহ আরো বেশ কিছু আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে।

ভূতত্ত্ববিদ ও জ¦ালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে হলে বড় ধরনের বিদ্যুৎ প্রকল্প নিতে হবে। কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পও গ্রহণ করা যেতে পারে। জার্মানি আবার কয়লায় ফিরে গেছে। ভারত-চীন নিজেদের কয়লা উত্তোলন অব্যাহত রেখেছে। বিগত কয়েক বছরে সারাবিশ্বে কয়লার ব্যবহার ৫ শতাংশ বেড়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে পিছিয়ে থাকলে চলবে না। তিনি বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ায় বিদ্যুতের সংকট ও ভোগান্তি আগের চেয়ে কমেছে। এখন ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা আমদানি করে রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হচ্ছে। এতে খরচ বেশি হচ্ছে। আমাদের দেশীয় কয়লা উত্তোলন ও ব্যবহার করা গেলে উৎপাদন খরচ আরো কমে আসবে। মাটির নিচে কয়লা সম্পদ রেখে লাভ নেই, এটা ব্যবহারেই বেশি লাভ। দেশীয় খনির কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জন্য বড় ধরনের অবদান রাখতে পারে। বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা উঠছে। এখন ফুলবাড়ী ও দীঘিপাড়ার খনি থেকে কয়লা ওঠানোর সুযোগ রয়েছে। এটা ব্যবহার করতে পারলে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনি উৎপাদন খরচ অনেক কমে যাবে। ভালো খবর হচ্ছে, সরকারও কয়লার ওপর জোর দিয়েছে। আমাদের দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল না, কিন্তু এখন বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে না হোক ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে বড়পুকুরিয়ার খনির মতো কয়লা উঠাতে হবে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা ওঠালে বছরে ৪ থেকে ৬ মিলিয়ন টন কয়লা ওঠানো সম্ভব। তবে এতে মানুষ, জীবন, প্রকৃতি-পরিবেশ, কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটবে। এটা মেনে নেয়া যায় না এবং তা খুবই যৌক্তিক। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই পদ্ধতির ঘোরবিরোধী। এক্ষেত্রে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই কয়লা ওঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। রংপুর-দিনাজপুরের খনিগুলোয় ৩শ থেকে ৪শ মিটার গভীরে কয়লা রয়েছে। সেগুলো আগে ওঠাতে হবে। বড়পুকুরিয়ার খনি থেকে বছরে ১ মিলিয়ন টন কয়লা ওঠানো হয়েছে। নতুন সবকটি মিলিয়ে যদি আমরা এটা দ্বিগুণ করতে পারি তাহলে আমদানি থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত নিতে অনেক সাশ্রয় হবে।


শেয়ার করুন