রাজশাহী মহানগরীর ঘোড়ামারা বাজার এলাকায় ব্যাংকে মর্গেজ দেওয়া দুই শতক পরিমাণ জমি আদালতের মাধ্যমে কিনে নেন হারুন অর রশিদ নামের এক ব্যক্তি। প্রায় ১০ বছর আগে ওই জমিটি কিনে নামজারিসহ অদ্যবোধি খাজনা পরিশোধ করে আসছেন তিনি। কিন্তু সম্প্রতি জমিটি নিজের কেনা বলে দখর করেছেন স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গোরা।
ইসলামী ব্যাংকে মর্গেজ রাখা আসাদুজ্জামান সরকার নামের এক ব্যক্তির নিকট থেকে নগরীর ঘোড়ামারা এলাকায় ওই জমিটি কিনতে ব্যাংককে ৪২ লাখ টাকা দেনা পরিশোধ করতে হয়েছিল হারুন অর রশিদকে। অথচ জমিটি জোর করে দখলে করে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের এক নেতা।
সোনা মসজিদ স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী হারুন অর রশিদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ার সুবাদে আমার জায়গাটি জোর করে দখল করে আছেন। এর বাইরে তার নিকট কোনো কাগজপত্র নাই। পুলিশ বার বার তাঁকে সরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই আবার এসে দখল করছেন।
সরেজমিন ঘুরে ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু ঘোড়ামারার এই জায়গাটিই নয়, শহরজুড়ে শত শত কোটি টাকা মূল্যের জমি জোর করে দখলে রেখেছেন সরকার দলের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন অংগ-সংঙ্গঠনের নেতাকর্মীরা। এমনকি নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে স্থানীয় অন্তত ১৫ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ভূমিদস্যূতার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। কাউন্সিলদের এ ভূমিদস্যূতা নিয়ে একাধিক ব্যক্তি খোদ সিটি মেয়র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে অভিযোগও করেছেন। মেয়র কোনো কোনো অভিযোগের সুরাহার করতে পারছেন কোনোটির পারছেন না। ফলে জমির জোরপূর্বক দখল নিয়ে বিবাদ বাড়ছেই।
জমি মালিকরা অভিযোগ করে জানিয়েছেন, নগরজুড়ে জমির দালাল নামে অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি মানুষের জমি দখল করছে। তাঁরা কেউ কেউ জিরো থেকে কোটিপতি বনেও গেছে শুধু মানুষের জমি দখল করে ভয় দেখিয়ে কমমূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করে। এসব দালালদের কারণে কোনো ব্যক্ত সহজে জমি কেনাবেচা করতে পারছেন না। তাদের মোটা অংকের কমিশন না দিলে জমি কেনা-বেচা করতে গেলেই বাধা দেওয়া হচ্ছে।
এসব ভূমিদস্যদের নেপথ্য শক্তি হয়ে কাজ করছেন স্থানীয় থানা পুলিশও। জমির মূল মালিকদের পক্ষে থানায় অভিযোগ করা হলেও উল্টো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ প্রভাবশালীদের পক্ষ অবলম্বন করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে অহরহ। এর ফলে জমি নিয়ে মারামারি, খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছেও।
গত বছরের ৩০ জুন নগরীর দাঁশপুকুর এলাকায় জমির দখল নিয়ে সংঘর্ষের সময় বিএনপি নেতাকর্মীদের ও সঙ্গে স্থানীয় ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা কামাল হোসেন গ্রুপের দুইজন নিহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পরে দুটি মামলা দায়ের হয়। একটি মামলায় কাউন্সিলর কামাল হোসেন এক নম্বর আসামি রয়েছেন।
নগরীর ১৭ নম্বর ওয়ার্ড শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন এক আওয়ামী লীগ নেতা জমি দখল করে। রাজশাহী নগরীর নওদাপাড়া এলাকায় রয়েছে তার নামে বেনামে অন্তত ৫০ বিঘা জমি। যেগুলোর বেশিরভাগই জোর করে দখল করা। এই নেতা ও জনপ্রিতিনিধির বিরুদ্ধে নগরীর শাহ মখদুম থানা ও সিটি মেয়রের কাছে অন্তত ১০টি অভিযোগ রয়েছে জমি দখলের। এমনকি তাঁর দোকান থেকে রড সিমেন্ট না নিলেও বাড়ি করতে বাধা প্রদান করা হয় জমি মালিকদের। এমন অভিযোগও করেছেন ওই এলাকার বাসিন্দা মাজেদুর রহমান, নাইমুর রহমানসহ অনেকেই।
অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, নগরজুড়েই এমন ভূমিদস্যূদের দাপট বিরাজ করছে। বিবাদমান কোনো জমির সন্ধান পেলেই ভূমিদস্যুরা হামলে পড়ছে। কখনো কখনো নিজেরাই দখল করে নিচ্ছে দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের সুযোগে। নগরীর ১,৩, ১৩, ৪, ১৮, ১৯, ২১, ২৩, ২৪, ২৮, ৩০সহ প্রায় সবকটি ওয়ার্ডেই ভূমিদস্যূরা বহাল তবিয়তে রয়েছেন। কোথাও কোনো ব্যক্তি জমি বিক্রি করতে গেলেই এসব ভূমিদস্যরা হামলে পড়ছেন। যাঁদের নেপথ্যে নেতৃত্বে দিচ্ছেন অধিকাংশ ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও। যারা সরকার দলের সমর্থক ও প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত।
এমনকি স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা জমি দখলের বাণিজ্যে লিপ্ত রয়েছেন। আবার কখনো কখনো তাঁরাই সমঝোতার নাম করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ থেকে কোটি টাকা।
নগরীর এসব জমি দখল বাণিজ্য নিয়ে জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, সাম্প্রতিক সমেয় থানায় যেসব অভিযোগ আসছে, তার মধ্যে অন্তত ৩০ ভাগই জমি নিয়ে দ্বন্দ্বের অভিযোগ। তবে আমরা এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অনেক অভিযোগই পুলিশ সুরাহার চেষ্টা করে।’